উৎসব মানবজাতির আনন্দ, সৌহার্দ্য ও মিলনের প্রতীক। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, অনেক সময় এই আনন্দঘন মুহূর্তগুলো রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এবং বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার উপমহাদেশে দেখা যায়, অন্য ধর্মাবলম্বীদের উৎসবের সময় কিছু মৌলবাদী গোষ্ঠী উগ্র আচরণ করে থাকে। প্রশ্ন ওঠে—কেন এই সহিংসতা? ধর্মীয় উৎসবের মতো সাংস্কৃতিক আয়োজনে কেন মৌলবাদীরা সহনশীলতা হারায়?
এই ব্লগে আমরা ঐতিহাসিক, সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই প্রশ্নটির উত্তর অনুসন্ধান করবো।
১. মৌলবাদের সংজ্ঞা ও স্বরূপ
মৌলবাদ (Fundamentalism) মূলত এমন একটি মতবাদ, যেখানে ধর্মীয় বিশ্বাসকে আক্ষরিকভাবে পালন ও প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া হয়। অনেক সময় এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেও ব্যবহৃত হয়। মৌলবাদীরা ধর্মকে একটি “চূড়ান্ত পরিচয়” হিসেবে তুলে ধরে এবং তারা ভিন্ন মত বা পথকে সহ্য করতে পারে না। এই অসহিষ্ণুতাই সহিংসতার অন্যতম মূল কারণ।
২. ‘আমরা বনাম তারা’ মানসিকতা
মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় ingroup-outgroup bias। যখন কোন গোষ্ঠী নিজেকে “শুদ্ধ” এবং অপরকে “অবিশ্বাসী”, “ভ্রান্ত”, বা “শত্রু” হিসেবে চিহ্নিত করে, তখন সেই ‘অন্যদের’ প্রতি সহানুভূতির জায়গা থাকে না। এই মানসিকতা অনেক সময় উৎসবের মতো প্রকাশ্য আনন্দঘন মুহূর্তগুলোকে তাদের কাছে ধর্মীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে প্রতিভাত করে।
৩. রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও সামাজিক উত্তেজনা
ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার প্রবণতা অনেক জায়গায় দেখা যায়। উৎসবকে ঘিরে উত্তেজনা তৈরি করে মৌলবাদীরা প্রায়শই জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এবং উগ্রপন্থাকে正当化 (ন্যায়সঙ্গত) করার চেষ্টা করে। এই সহিংসতা সমাজে বিভাজন তৈরির জন্য একটি ‘যন্ত্র’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
উদাহরণ:
- ভারতে দিওয়ালি, ঈদ বা খ্রিস্টমাসের সময় উগ্র গোষ্ঠীদের কিছু বক্তব্য বা আচরণ।
- বাংলাদেশের দুর্গাপূজা বা বড়দিনকে ঘিরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা।
- পাকিস্তানে হিন্দু, শিখ বা খ্রিস্টান উৎসবের সময় হামলা ও ধর্মীয় বিদ্বেষ।
৪. সামাজিক মাধ্যম ও গুজবের ভূমিকা
বর্তমানে সামাজিক মাধ্যম অনেক সময় ভুল তথ্য, উস্কানিমূলক পোস্ট ও গুজব ছড়ানোর মাধ্যম হয়ে উঠেছে। উৎসবকালীন গুজব ছড়িয়ে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘৃণা উস্কে দেওয়া হয়। এই ডিজিটাল উগ্রতার প্রভাব বাস্তব দাঙ্গা বা হামলার রূপ নিতে পারে।
৫. শিক্ষার অভাব ও ধর্মীয় ভুল ব্যাখ্যা
শিক্ষার অভাব এবং ধর্মগ্রন্থের সঠিক ব্যাখ্যা না জানার কারণে অনেকেই উগ্রপন্থী প্রচারে সহজে প্রভাবিত হয়। তাদের কাছে অন্য ধর্মের উৎসব মানেই ‘ইসলামের (বা অন্য ধর্মের) অবমাননা’—যা একেবারেই ভুল ও বিভ্রান্তিকর।
৬. প্রতিরোধের উপায়
- ধর্মীয় সহিষ্ণুতা শিক্ষা: সব ধর্মেই সহানুভূতি ও শান্তির শিক্ষা রয়েছে। সেগুলোর প্রচার ও চর্চা বাড়াতে হবে।
- আইনশৃঙ্খলা ও দ্রুত বিচার: উৎসবকালীন উস্কানি ও সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
- মাধ্যমিক শিক্ষা পাঠ্যক্রমে পারস্পরিক শ্রদ্ধা বিষয়ক অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
- সচেতন নাগরিক সমাজ: সামাজিক মাধ্যম, পাড়া-মহল্লা, মসজিদ-মন্দির-গির্জা—সবখানে মানবিকতা ও সম্মানের বার্তা ছড়াতে হবে।
অন্য ধর্মের মানুষদের উৎসবের সময় মৌলবাদীদের সহিংসতা একটি সমাজিক ব্যাধি, যার শিকড় রাজনৈতিক লোভ, ধর্মীয় অন্ধত্ব ও সামাজিক অসচেতনতার ভেতরে প্রোথিত। ধর্ম হোক মানুষকে একতাবদ্ধ করার মাধ্যম—বিভাজনের নয়। মানবতা, সহনশীলতা ও শিক্ষাই হতে পারে এই অন্ধকার থেকে আলোর পথ।