বাংলাদেশে ট্রান্সজেন্ডার শব্দটি এখনও একটি বিভ্রান্তির উৎস। কেউ বলেন “হিজড়া,” কেউ বলেন “তৃতীয় লিঙ্গ,” কেউ বা “অস্বাভাবিক।” কিন্তু এই শব্দগুলোর অধিকাংশই একদিকে যেমন সমাজের বদ্ধমূল ধারণাকে প্রকাশ করে, অন্যদিকে আবার একটি গুরুত্বপূর্ণ মানবিক বাস্তবতাকে সংকীর্ণ করে তোলে। আমরা যদি সত্যিই একটি সমানাধিকারভিত্তিক সমাজ চাই, তবে আমাদের আগে বুঝতে হবে—ট্রান্সজেন্ডার কারা, তারা কীভাবে সমাজের অংশ, এবং তাদের বিরুদ্ধে আমাদের মনে গেঁথে থাকা ভ্রান্ত ধারণাগুলোর পেছনে কোন সমাজতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক নির্মাণ কাজ করেছে।
ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিরা সেই সব মানুষ, যাদের লিঙ্গ পরিচয় তাদের জন্মলগ্নে নির্ধারিত যৌনাঙ্গের সাথে মেলে না। অর্থাৎ, একজন মানুষ যার জন্মগতভাবে “পুরুষ” বা “নারী” লিঙ্গ নির্ধারিত হলেও, তার মানসিক, সামাজিক বা আত্মপরিচয় হতে পারে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এটি নিছকই এক মানসিক বা সামাজিক ব্যাপার নয়, এটি জীববিজ্ঞানের জটিল বাস্তবতার অংশ—যেখানে ক্রোমোজোম, হরমোন, ও নিউরোসাইকোলজিক্যাল উপাদান ভূমিকা রাখে। এই সত্যকে অস্বীকার করা বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে উপেক্ষা করার নামান্তর।
বাংলাদেশের সমাজে দীর্ঘদিন ধরে হিজড়া সম্প্রদায়কে উপহাস, ভয় ও অবহেলার চোখে দেখা হয়েছে। তাদের অধিকাংশকে পারিবারিকভাবে পরিত্যাগ করা হয়, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে প্রবেশাধিকার নেই বললেই চলে, ফলে তারা নিরুপায় হয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান বা শিশুর জন্মে “দোয়া” করে অর্থ উপার্জনের পথ বেছে নেয়—যা আবার সমাজের আরেকটি বিদ্রূপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অথচ এই জীবন তাদের পছন্দের ফল নয়, এটি সমাজের নির্মিত এক ধরনের প্রান্তিকতা। আমরা যদি তাদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতাম, তাদের কর্মসংস্থানে অন্তর্ভুক্ত করতাম, তবে এই রাস্তায় তাদের নামতে হতো না।
বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে ‘হিজড়া’ জনগোষ্ঠীকে “তৃতীয় লিঙ্গ” হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। পরবর্তীতে ২০২১ সালে ভোটার তালিকায় “তৃতীয় লিঙ্গ” হিসেবে পরিচয় দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। একে অনেকেই মানবাধিকারের অগ্রগতি হিসেবে দেখলেও, বাস্তব চিত্র ভিন্ন। এই আইনি স্বীকৃতির পাশাপাশি সামাজিক স্বীকৃতি অর্জন না হলে তা নিছকই একটি রাজনৈতিক কাগুজে উদ্যোগ হিসেবে থেকে যায়। ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের আজও সরকারি চাকরিতে গ্রহণ করা হয় না, ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলা কঠিন, হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকরা কীভাবে তাদের চিকিৎসা করবেন তা জানেন না। এটি আইন আর বাস্তবতার মধ্যকার এক গভীর ব্যবধানের উদাহরণ।
সমস্যার গভীরে গেলে দেখা যায়, ট্রান্সজেন্ডারদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যার মিশেলে। অনেকেই মনে করেন, এটি “পাপ,” “প্রকৃতির বিপরীত,” কিংবা “আল্লাহর শাস্তি।” অথচ ইসলাম, হিন্দুধর্ম কিংবা অন্যান্য ধর্মগুলো ট্রান্সজেন্ডার বিষয়কে সরাসরি নিন্দা করে না; বরং অনেক ঐতিহাসিক ব্যাখ্যায় দেখা যায়, ট্রান্সজেন্ডার বা ইন্টারসেক্স মানুষদের প্রতি সহানুভূতি ও সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। মহানবী (সা.)-এর যুগেও “মুখান্নাস” নামক একটি লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় গোষ্ঠীর কথা হাদিসে এসেছে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ধর্মীয় ব্যাখ্যাগুলো সমাজের সুবিধামতো রূপ পেয়েছে, যাতে প্রভাব বিস্তারকারী গোষ্ঠীগুলোর আধিপত্য বজায় থাকে।
বাংলাদেশে অনেক ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি আছেন, যারা লেখাপড়া করেছেন, চাকরি করতে চেয়েছেন, সমাজের মূলধারায় অবদান রাখতে চেয়েছেন। কিন্তু সমাজ তাদের দিকে সেই সুযোগটি বাড়িয়ে দেয়নি। তাদের জীবন যেন কেবল “উপদ্রব” বা “হেয় করার বিষয়” হিসেবে দেখা হয়। অথচ জাতিসংঘ বলছে, টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (SDG) অর্জনে কাউকে পেছনে ফেলে রাখা যাবে না। তাহলে ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিরা এই “কেউ” নন কেন?
সাম্প্রতিক সময়ে কিছু উদ্যোগ যেমন ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ, নারী দিবসে তাদের আমন্ত্রণ, কিংবা কিছু সংস্থায় তাদের চাকরিতে অন্তর্ভুক্তি—এই প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়। তবে এগুলো এখনো বিচ্ছিন্ন এবং প্রতীকি মাত্র। মূলধারায় ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য সুযোগ তৈরি না হলে এটি কেবলই পৃষ্ঠতলের আলংকারিক পরিবর্তন হয়ে থাকবে।
সমাজে বিদ্যমান এই বৈষম্যমূলক মানসিকতা দূর করতে হলে দরকার শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার। পাঠ্যপুস্তকে লিঙ্গ বৈচিত্র্যকে বৈজ্ঞানিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণে তুলে ধরতে হবে। গণমাধ্যমকে ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের “অদ্ভুত চরিত্র” হিসেবে দেখানো বন্ধ করতে হবে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, আমাদেরকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে এই ধারণাটি বদলাতে হবে যে, লিঙ্গ শুধুমাত্র শরীর দ্বারা নির্ধারিত হয় না; এটি একজন মানুষের আত্মপরিচয়ের মৌলিক দিক।
আমরা যতক্ষণ না পর্যন্ত এই বৈচিত্র্যকে “অস্বাভাবিকতা” না ভেবে মানবিক স্বীকৃতি দিচ্ছি, ততক্ষণ আমাদের মানবতাবাদ ও ন্যায়বিচারমূলক সমাজ গঠনের দাবি ফাঁকা বুলি ছাড়া আর কিছুই নয়।