আমরা মানুষ। আমাদের জন্ম হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান বা বৌদ্ধ হয়ে নয়—মানুষ হয়ে। ধর্ম আমাদের পরিচয়ের একটি অংশ হলেও, সেটি আমাদের মানবিকতার উপরে নয়। দুর্ভাগ্যবশত, আজকের সমাজে ধর্মকে মানুষ ও মানবতার চেয়ে বড় করে দেখা হচ্ছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধুমাত্র বিভাজন সৃষ্টি করে না, বরং মানুষের মূল গুণ—সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও সহানুভূতির—অবমূল্যায়ন ঘটায়।
১. মানুষই ধর্ম সৃষ্টি করেছে, ধর্ম মানুষকে নয়
ধর্ম এসেছে মানুষের নৈতিকতা, সমাজগঠন এবং আত্মিক প্রশান্তির প্রয়োজনে। যুগে যুগে বিভিন্ন ধর্ম মহান মানবিক মূল্যবোধের ওপর দাঁড়িয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই ধর্মের উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষকে সঠিক পথে চালিত করা, কোনোভাবেই মানবতাকে চাপা দেওয়া নয়। যদি কোনো ধর্মীয় চর্চা বা ব্যাখ্যা মানুষের প্রতি ঘৃণা, সহিংসতা বা বৈষম্য তৈরি করে—তাহলে তা ধর্ম নয়, মানুষের ভুল ব্যাখ্যা।
২. মানবতা সব ধর্মের মূল শিক্ষা
প্রতিটি ধর্মই মানুষকে ভালোবাসতে, অন্যের পাশে দাঁড়াতে এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের শিক্ষা দেয়।
- ইসলাম বলে: “তোমরা একে অপরকে সাহায্য করো ন্যায়ের ও সদাচরণের কাজে।”
- হিন্দুধর্মে আছে: “অহিংসা পরম ধর্ম।”
- খ্রিস্টধর্মে বলা হয়: “তোমার প্রতিবেশীকে নিজের মতো ভালোবাসো।”
- বৌদ্ধ ধর্মে অহিংসা ও দয়া হচ্ছে মূল ভিত্তি।
তবে, যখন ধর্মীয় পরিচয় আমাদেরকে বিভক্ত করে ফেলে, তখন আমরা বুঝতে পারি, মানবতা হারিয়ে যাচ্ছে।
৩. ধর্ম মানুষকে বিভক্ত করতে নয়, একত্র করতেই ছিল
একজন দরিদ্র মানুষকে ধর্ম অনুযায়ী সাহায্য না করে উপেক্ষা করলে, সেটা কি ধর্মীয় আচরণ? একজন আহত মানুষ রাস্তায় পড়ে আছে—সে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান কি জিজ্ঞাসা করার আগে কি আমরা মানুষ হিসেবে দায়িত্ববোধ দেখাতে পারি না? একটি শিশুর কান্না শুনে আমরা তার ধর্ম জিজ্ঞাসা করি না—আমরা এগিয়ে যাই, কারণ সেটা মানবতা। এই সহজ সত্যই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়—মানবতা আগে, তারপর ধর্ম।
৪. ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে মানবিক পরিচয় বড়
পৃথিবী আজ যুদ্ধ, সাম্প্রদায়িকতা, ঘৃণা আর বিভাজনে জর্জরিত। এ অবস্থায় আমাদের প্রয়োজন এমন মানুষ, যারা আগে মানুষ হিসেবে ভাববে, তারপর ধর্মীয় পরিচয় অনুযায়ী। যে ব্যক্তি অন্যকে ভালোবাসতে জানে, দয়া দেখাতে জানে, সে-ই প্রকৃত ধার্মিক—ধর্মগ্রন্থ মুখস্থ জানা কিংবা আচার পালন নয়।
৫. মানবতা ব্যতীত ধর্ম একটি খোলস মাত্র
ধর্ম তখনই মহৎ যখন তা মানুষকে আরও উদার, সহনশীল ও সহানুভূতিশীল করে তোলে। যদি কোনো ধর্মীয় চর্চা মানবতাবিরোধী হয়ে পড়ে, তবে সেটি ধর্ম নয়—তা হচ্ছে গোঁড়ামি। একটা গোঁড়া মন যা অন্যকে আঘাত করে, ঘৃণা ছড়ায় বা অন্য মতকে সহ্য করতে পারে না, তা কোনো ধর্মই সমর্থন করে না।
আজ আমাদের সবচেয়ে প্রয়োজন সহানুভূতিশীল, মানবিক মানুষ। ধর্মীয় পরিচয়ের আগেই আমরা যেন নিজেকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলি। ধর্ম হোক আত্মিক পথচলার উপায়—মানবতা হোক তার ভিত্তি। ধর্মের আগে মানুষ—এই বোধ যত বিস্তৃত হবে, তত শান্তিময় হবে সমাজ, বিশ্ব, এবং আমাদের ভবিষ্যৎ।