বাল্যবিবাহের অর্থ ও বর্তমান প্রেক্ষাপট
বাল্যবিবাহ বলতে বোঝানো হয় যখন কোনো কিশোরী বা কিশোর পারিপার্শ্বিকভাবে অপ্রাপ্ত বয়সে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অনুসারে, ১৮ বছরের নিচে হওয়া বিবাহ বাল্যবিবাহ হিসেবে গণ্য হয়। বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ একটি ব্যাপক সামাজিক সমস্যা, যেখানে বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে এর প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিকসমূহ
১. শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব
বাল্যবিবাহের ফলে কিশোরীর শরীর ও মন এখনও পূর্ণভাবে বিকশিত না হওয়ায় প্রেগন্যান্সি ও প্রসবের সময় বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়। এটি মা ও শিশুর মৃত্যুর ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। মানসিক স্তরে বাল্যবিবাহী মেয়েরা সাধারণত চাপ, দুশ্চিন্তা এবং অবসাদে ভুগে।
৩. অর্থনৈতিক সঙ্কট
বাল্যবিবাহীরা প্রায়ই স্বল্প শিক্ষিত ও অদক্ষ হওয়ায় ভালো চাকরি বা ব্যবসা করতে পারে না। ফলে পরিবারের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি হয়।
৪. নারীর অধিকার লঙ্ঘন
বাল্যবিবাহ নারীর ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও অধিকার হরণের অন্যতম কারণ। তারা প্রায়ই পারিবারিক ও সামাজিক নির্যাতনের শিকার হয়।
বাংলাদেশে ইসলামিক মৌলবাদীদের দৃষ্টিকোণ
বাংলাদেশে কিছু ইসলামিক মৌলবাদী গোষ্ঠী বাল্যবিবাহের পক্ষে অবস্থান নিতে দেখা যায়। তাদের যুক্তি প্রায়শই ধর্মীয় ও ঐতিহ্যগত ভিত্তিক হয়:
ধর্মীয় স্বীকৃতি
মৌলবাদীরা বলে থাকে, ইসলামে নির্দিষ্ট কোনো বয়সের বিধান নেই যে অনুযায়ী বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ। নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর যুগে অনেক কিশোরী অল্প বয়সে বিবাহ করেছিলেন। তাই তারা বর্তমানের আইনগত বয়স সীমা সমর্থন করে না।
ঐতিহ্য ও সামাজিক প্রথা
অনেকে বলেন, বাল্যবিবাহ গ্রামীণ ও কুসংস্কারমুক্ত সমাজ গঠনের অংশ, যেখানে মেয়েদের নিরাপত্তা ও সম্মানের জন্য এ ধরনের বিবাহ প্রয়োজনীয়।
অর্থনৈতিক কারণ
কিছু মৌলবাদী গোষ্ঠী বাল্যবিবাহকে দরিদ্র পরিবারের জন্য আর্থিক বোঝা কমানোর উপায় হিসেবেও দেখে।
আধুনিক সমাজ ও মানবাধিকার দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যা
অন্যদিকে, দেশের আধুনিক ও মানবাধিকার কর্মীরা বাল্যবিবাহকে নারীর মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন হিসেবে দেখে। তারা বলছেন:
- বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ধর্মীয় শিক্ষাবিদ ও নেতৃবৃন্দের সহায়তা প্রয়োজন।
- ধর্ম ও ঐতিহ্যের নামে নারীর স্বতন্ত্র উন্নয়ন বন্ধ করা উচিত নয়।
- শিক্ষার প্রসার ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি বাল্যবিবাহ রোধে কার্যকরী হাতিয়ার।
সমাধানের পথ
বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ রোধে দরকার সমন্বিত প্রচেষ্টা:
- শিক্ষা প্রসার
মেয়েদের স্কুলে ভর্তি ও শিক্ষাজীবন দীর্ঘ করার উদ্যোগ নিতে হবে। - আইনি ব্যবস্থা কঠোর করা
বাল্যবিবাহের জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ জরুরি। - ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্ততা
ইসলামী শিক্ষাবিদদের সচেতন করে, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিক বোঝানো দরকার। - সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি
মিডিয়া ও সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে বাল্যবিবাহের বিপর্যয় জনসমক্ষে আনা জরুরি।
বাল্যবিবাহ বাংলাদেশের একটি গভীর সামাজিক সমস্যা, যার প্রভাব মেয়েদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অধিকার ও ভবিষ্যত জীবনকে প্রভাবিত করে। ইসলামিক মৌলবাদীরা ধর্মীয় ও ঐতিহ্যগত যুক্তিতে বাল্যবিবাহ সমর্থন করলেও আধুনিক সমাজ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো এটি বন্ধে কাজ করে যাচ্ছে। সমগ্র জাতির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাল্যবিবাহের অভিশাপ থেকে দেশকে মুক্ত করা সম্ভব।