বাংলাদেশের সমাজে মুক্তচিন্তাকারীদের প্রতি একটি দুঃখজনক এবং ক্রমবর্ধমান ঘৃণামূলক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। “ইহুদি”, “নাসারা”, “মালাউন” — এই শব্দগুলো প্রায়শই তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এসব শব্দের ব্যবহার শুধু একটি মতাদর্শগত বিরোধ নয়, বরং এটি একটি সাংস্কৃতিক সহিংসতার রূপ ধারণ করেছে, যেখানে যে কেউ ধর্মীয় মৌলবাদের বাইরে চিন্তা করলেই সে ‘শত্রু’ হয়ে ওঠে।
ঘৃণার উৎপত্তি কোথায়?
এই বিদ্বেষের মূল শিকড় নিহিত আছে ধর্মীয় উগ্রবাদে, যা একমুখী চিন্তাকে সর্বোচ্চ সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। বাংলাদেশের বহু মাদ্রাসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শিশুদের ছোটবেলা থেকে শেখানো হয়— “যারা ইসলামকে প্রশ্ন করে, তারা নাস্তিক, কুফরি করে”, “ইহুদি-নাসারা আমাদের শত্রু”, এবং “মালাউনদের সঙ্গে সম্পর্ক হারাম।” এই বীজগুলো যখন প্রাতিষ্ঠানিক, পারিবারিক ও সামাজিক অনুকরণে সেচ পায়, তখন ঘৃণার গাছ ফল দেয়।
‘মালাউন’ শব্দটি কীভাবে ব্যবহার হয়?
‘মালাউন’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ “অভিশপ্ত”। এটি উপমহাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়কে অপমান করার জন্য ব্যবহৃত একটি শব্দ, যা পরে মুক্তচিন্তাকারীদের বিরুদ্ধেও প্রয়োগ করা শুরু হয়েছে। এখন, কেউ ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ চায়, নারী অধিকার বা বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলে, তাহলেই তাকে ‘মালাউন’ বলে চিহ্নিত করা হয়। যেন চিন্তা করাটাই এখন ‘অপরাধ’।
এই ঘৃণার ফল কী?
১. সামাজিক বৈষম্য ও নিপীড়ন: যারা মুক্তচিন্তার চর্চা করে, তারা পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে বা সমাজে নিঃসঙ্গ ও অবহেলিত হয়ে পড়ে।
২. নিরাপত্তাহীনতা: অনেকেই হত্যার হুমকি পান; অতীতে আমরা দেখেছি অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর বাবু, অনন্ত বিজয়দের করুণ পরিণতি।
৩. মেধা পাচার: বাংলাদেশে বসে যারা চিন্তা করতে চায়, তারা বাধ্য হয় দেশ ছাড়তে। এতে দেশের জ্ঞানসম্ভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রতিকার কীভাবে সম্ভব?
ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হলে আমাদের কিছু বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ নিতে হবে:
১. শিক্ষায় ধর্মনিরপেক্ষতা ও যুক্তির চর্চা
স্কুল পর্যায় থেকেই নৈতিকতা, বিজ্ঞানমনস্কতা এবং যুক্তি নির্ভর চিন্তা শেখাতে হবে। ধর্মীয় সহনশীলতা এবং বিভিন্ন বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার শিক্ষা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
২. সামাজিক প্রচারণা
জনপ্রিয় লেখক, ইউটিউবার, সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদদের এগিয়ে আসতে হবে। ঘৃণার ভাষার বিপরীতে ভালোবাসা, যুক্তি ও সহানুভূতির ভাষা চর্চা করতে হবে। প্রগতিশীল ইসলামী চিন্তাবিদদেরও জোরালোভাবে বলতে হবে— ইসলাম কখনোই অন্যকে অভিশাপ দেয় না।
৩. আইনি প্রতিকার
ঘৃণাত্মক বক্তব্য ও হিংসার উসকানির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট আইন প্রয়োগ করতে হবে। যারা সামাজিক মাধ্যমে ধর্মের নামে ঘৃণা ছড়ায়, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে, তবে সেটা গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সীমারেখা মেনেই।
৪. সংলাপ ও পারস্পরিক বোঝাপড়া
ধর্মবিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসী উভয়ের মধ্যে এক ধরণের মানবিক সংলাপ প্রয়োজন, যেখানে শ্রদ্ধা থাকবে, শত্রুতা নয়। মতের ভিন্নতা মানেই শত্রুতা নয়— এই বোধ সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রযাত্রা থেমে যাবে যদি চিন্তা করা অপরাধ হয়। ‘মালাউন’ শব্দটি দিয়ে কেউ কারো আত্মপরিচয়কে কলুষিত করতে পারে না, যদি আমরা সবাই মিলে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াই। ঘৃণার বিপরীতে ভালোবাসা, ভয়ের বিপরীতে যুক্তি— এটাই হতে হবে আমাদের জবাব।