বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম, যার শিকড় এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দেওয়া দলটি দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আজ দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। তবে গত এক দশকের অধিক সময় ধরে আওয়ামী লীগের শাসনকাল নিয়ে দেশের ভেতরে-বাইরে উদ্বেগ ও প্রশ্ন ক্রমেই বেড়ে চলেছে—এটা কি গণতন্ত্র, নাকি এক ধরনের আধুনিক একদলীয় শাসন?
নির্বাচন ও গণতন্ত্রের সংকট
২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন ছিল বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য দুটি টার্নিং পয়েন্ট। ২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপি ও অন্যান্য প্রধান বিরোধীদল বর্জন করে, যার ফলে ১৫৪ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এর ফলে নির্বাচন কার্যত একতরফা হয়ে ওঠে এবং ভোটাধিকার হরণ হয় লক্ষ লক্ষ নাগরিকের। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ব্যাপক ভোট কারচুপি, ব্যালট বাক্স ভর্তি, এবং বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের গ্রেপ্তার ও হয়রানির অভিযোগ ওঠে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরাও এ নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু বলতে দ্বিধা প্রকাশ করেন।
প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার রাজনীতিকরণ
বর্তমান সরকারের সময়কালে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেক সময়েই দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিরোধীদের সভা-সমাবেশে অনুমতি না দেওয়া, গণমাধ্যমে নজরদারি, ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত করা—এসবই এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসনের ইঙ্গিত দেয়।
বিচার বিভাগ, যা গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ, সেটিও দলীয় প্রভাবমুক্ত আছে কিনা—এ নিয়ে জোর বিতর্ক রয়েছে। রাজনৈতিক মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি, অথচ মানবাধিকার লঙ্ঘনের মামলা বা দুর্নীতির তদন্তে ধীরগতি—এটা বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতার প্রতি আস্থা হ্রাস করেছে।
গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
গণতন্ত্রের মৌল ভিত্তি হলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। কিন্তু বাংলাদেশে এই অধিকার ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। সাংবাদিকদের ওপর নজরদারি, সংবাদমাধ্যমের ওপর চাপ, ও সোশ্যাল মিডিয়ায় মতপ্রকাশের কারণে গ্রেপ্তার—এসব বিষয় বারবার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (RSF)-এর মতে, বাংলাদেশে সাংবাদিকরা ‘আতঙ্কের মধ্যে’ কাজ করছেন।
একক আধিপত্য বনাম বহুদলীয় রাজনীতি
আওয়ামী লীগের শাসনে বহুদলীয় রাজনীতি কার্যত অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। সংসদে কার্যকর বিরোধী দল নেই বললেই চলে। এমনকি স্থানীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও বিরোধীদের অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়েছে নানা কৌশলে। এই পরিস্থিতি গণতন্ত্রকে করে তুলেছে একদলীয়তার ছায়াতলে।
জনগণের ভূমিকা ও ভবিষ্যতের পথ
বাংলাদেশের জনগণ বরাবরই রাজনীতি সচেতন। কিন্তু দমন-পীড়নের পরিবেশে সক্রিয় নাগরিক অংশগ্রহণ দুরূহ হয়ে উঠেছে। তারপরও সামাজিক আন্দোলন, শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ, ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তরুণদের সক্রিয়তা একটি বিষয় স্পষ্ট করে—গণতন্ত্রের চেতনা এখনও নিঃশেষ হয়নি।
আগামী দিনের বাংলাদেশ কেমন হবে, তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা রক্ষা, এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের ওপর। একটি টেকসই গণতন্ত্র কেবল নির্বাচনের মাধ্যমে নয়, বরং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, জবাবদিহিমূলক প্রশাসন ও মানবাধিকারের নিশ্চয়তার মাধ্যমেই সম্ভব।
আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু যেকোনো দলের জন্যই দীর্ঘমেয়াদী শাসন গণতন্ত্রকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে, যদি জবাবদিহিতা ও ক্ষমতার ভারসাম্য না থাকে। আজকের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো, দল নয়—রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণে নিবেদিত একটি সুশাসন এবং সত্যিকারের গণতন্ত্রের চর্চা।