বাংলাদেশ, একটি বহু সাংস্কৃতিক ও বহুমাত্রিক জাতি রাষ্ট্র, যার আত্মপরিচয়ের মূলভিত্তি গঠিত হয়েছে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। বাঙালি সংস্কৃতি এই দেশের অস্তিত্ব, ইতিহাস ও চেতনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একটি মৌলবাদী গোষ্ঠী ধারাবাহিকভাবে এই সংস্কৃতির উপর আঘাত হানছে—একটি ভয়ঙ্কর সাংস্কৃতিক সংকট সৃষ্টি করে।
বাঙালি সংস্কৃতি: পরিচয় ও বৈচিত্র্য
বাঙালি সংস্কৃতি শুধু গান, নৃত্য, নাটক কিংবা উৎসবে সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি জীবনচর্যা—যেখানে সাহিত্য, ভাষা, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস ও চিন্তাভাবনার বহুবিধ রূপ প্রতিফলিত হয়। পহেলা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি, রবীন্দ্র-নজরুল চর্চা এবং লোকসংগীতের ধারাও এই সংস্কৃতির অংশ।
মৌলবাদীদের সংস্কৃতি-বিরোধী অবস্থান
বাংলাদেশে মৌলবাদী গোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে বাঙালি সংস্কৃতিকে “অইসলামিক” ও “বিদেশি সংস্কৃতির অনুকরণ” বলে অভিহিত করেছে। তারা মনে করে, পহেলা বৈশাখ, নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা, রবীন্দ্রসংগীত, নারী স্বাধীনতা, বা মিশ্র লিঙ্গভিত্তিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ধর্মীয় অনুশাসনের পরিপন্থী। এর ফলে দেখা যায়:
মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরোধিতা: প্রতিবছর মৌলবাদী গোষ্ঠী এই শোভাযাত্রাকে “হিন্দু সংস্কৃতির অংশ” আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলে।
নারী শিল্পীদের ওপর আক্রমণ: নারীদের নাচ, গান কিংবা মঞ্চে পারফর্ম করা নিয়ে তারা বারবার আপত্তি তোলে।
মঞ্চ নাটক, সিনেমা ও সাহিত্যের বিরুদ্ধে ফতোয়া: সাহিত্যিক ও শিল্পীদের “নাস্তিক”, “ইসলামবিদ্বেষী” ট্যাগ দিয়ে টার্গেট করা হয়।
আত্মঘাতী ও সহিংস আক্রমণ: ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত লেখক-প্রকাশকদের উপর একাধিক প্রাণঘাতী হামলা চালানো হয়।
মূল কারণসমূহ
১. অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতি শত্রুতা: বাঙালি সংস্কৃতি সাধারণত ধর্মনিরপেক্ষ ও মানবতাবাদী, যা মৌলবাদীদের সংকীর্ণ মতাদর্শের বিরোধী।
২. রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপব্যাখ্যা: মৌলবাদীরা সংস্কৃতিকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে জনগণকে বিভ্রান্ত করে।
৩. দারিদ্র্য ও শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা: অশিক্ষা ও অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে মৌলবাদীরা কূপমণ্ডুকতা ছড়িয়ে দেয়।
4. সামাজিক মিডিয়ায় উগ্র প্রচারণা: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তারা নানা ষড়যন্ত্রমূলক বক্তব্য ছড়িয়ে দেয়।
রাষ্ট্র ও সমাজের ভূমিকা
যেখানে সংবিধান সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করে, সেখানে রাষ্ট্রের নীরবতা বা দুর্বল প্রতিক্রিয়া সমাজে ভয় সৃষ্টি করে। সংস্কৃতি চর্চার পরিবেশ ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে পড়ে। সরকার যদিও মাঝে মাঝে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়, তা অনেক সময় পর্যাপ্ত বা স্থায়ী নয়।
ভবিষ্যতের করণীয়
- সাহসী সংস্কৃতিচর্চা: প্রতিরোধের ভাষা হতে পারে আরও বেশি সাহিত্য, নাটক, গান ও লোকসংস্কৃতির চর্চা।
- শিক্ষা ও সচেতনতা: ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংস্কৃতিক জ্ঞানকে একত্র করে নতুন প্রজন্মকে তৈরি করতে হবে।
- প্রগতিশীল আইন প্রয়োগ: মৌলবাদী সহিংসতায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কার্যকর বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
- মিডিয়ার দায়িত্বশীলতা: সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক প্ল্যাটফর্মে ধর্মান্ধ প্রচারণা রুখে দিয়ে মানবিক, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির প্রচার করতে হবে।
বাংলাদেশের আত্মপরিচয় মূলত বাঙালিত্ব ও ধর্মনিরপেক্ষতায় নিহিত। এই সংস্কৃতি ধ্বংসের যে কোনো প্রয়াস মূলত দেশের অস্তিত্বের উপর আঘাত। তাই মৌলবাদীদের এই আক্রোশ ও দমননীতি প্রতিরোধ করা শুধু শিল্পীদের দায়িত্ব নয়, বরং গোটা সমাজের।