বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ছাড়া বিচার অসম্ভব: রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার সময় এখনই
বাংলাদেশের ইতিহাসে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের শাসনামল এক ভয়াবহ দমন-পীড়নের সময়কাল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে উঠেছে। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার, শান্তিপূর্ণ সমাবেশে গুলি চালানো—এসব অপরাধে রাষ্ট্রের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার প্রমাণ সময় ও ইতিহাস বারবার উপস্থাপন করেছে।
এইসব অপরাধ শুধুমাত্র প্রশাসনিক “অতিরিক্ত ব্যবহার” হিসেবে দেখলে তা হবে ভয়াবহ মানবাধিকারের লঙ্ঘনকে তুচ্ছ করা। বরং এগুলো ছিল সুপরিকল্পিত, কাঠামোগত, এবং ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার নীলনকশার অংশ। আর এই অপরাধগুলোর বিচার সাধারণ সামরিক আদালত বা বাহিনীর অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থার মাধ্যমে নয়, বরং নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে গঠিত একটি স্বাধীন ‘বিশেষ ট্রাইব্যুনালের’ মাধ্যমে হওয়া জরুরি।
কেন সামরিক ট্রাইবুনাল নয়?
১. স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার অভাব:
সামরিক আদালত মূলত বাহিনীর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার জন্য গঠিত, যেখানে বাহিনীর হায়ারার্কির প্রতি আনুগত্যই বিচারিক প্রক্রিয়ার বড় চালিকাশক্তি। এই ধরনের কাঠামোয় বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে সত্যিকার বিচার হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।
২. বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে অপরাধ:
রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সদস্যরা যে অপরাধগুলো করেছেন, তা নিরীহ নাগরিকদের বিরুদ্ধে—যেমন: রাতের অন্ধকারে তুলে নেওয়া, র্যাব-পুলিশের ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যা, রাজনৈতিক কর্মীদের নিখোঁজ করা ইত্যাদি। এই অপরাধ বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে হওয়ায় এর বিচারও হওয়া উচিত নাগরিক সমাজের তত্ত্বাবধানে গঠিত স্বাধীন ট্রাইব্যুনালে।
৩. আন্তর্জাতিক মানদণ্ড:
গণহত্যা, গুম, এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ আন্তর্জাতিক অপরাধ (International Crimes)। আন্তর্জাতিক বিচার প্রক্রিয়ার মানদণ্ড অনুসরণ করেই এমন ট্রাইব্যুনাল গঠিত হওয়া উচিত। যেমনটি হয়েছিল রুয়ান্ডা, যুগোশ্লাভিয়া কিংবা সিয়েরা লিওনের ক্ষেত্রে।
বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের যুক্তি
১. জনগণের আস্থা ও অংশগ্রহণ:
একটি স্বতন্ত্র, নিরপেক্ষ ট্রাইব্যুনাল জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারে। এতে ভুক্তভোগী পরিবাররা সাক্ষ্য দিতে আগ্রহী হবে, তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা সহজ হবে।
- রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বিচার:
বিশেষ ট্রাইব্যুনাল আইনসভার অধীন হলেও বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতায় পরিচালিত হবে। ফলে সরকারের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে এটি নিরাপদ থাকবে—যা সামরিক বা পুলিশি কাঠামোতে সম্ভব নয়। - ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন:
এই ট্রাইব্যুনাল ভবিষ্যতের জন্য একটি সতর্ক সংকেত হবে: রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে কেউ চাইলেই জনগণের বিরুদ্ধে অপরাধ করে দায়মুক্তি পাবে না।
প্রস্তাবিত ট্রাইব্যুনাল কাঠামো কেমন হতে পারে?
- সাবেক বিচারপতি, মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ, আন্তর্জাতিক আইনজীবী ও নাগরিক সমাজ প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত একটি প্যানেল
- বিশেষ তদন্ত সংস্থা যা সরকারের নিয়ন্ত্রণে নয়
- প্রবেশযোগ্য তথ্যব্যবস্থা, যাতে জনগণ জানতে পারে মামলা কোথায় কী অবস্থায় আছে
- সাক্ষী সুরক্ষা কর্মসূচি, যা ভুক্তভোগী ও সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে
পরিশেষে এটাই বলার থাকে, ফ্যাসিস্ট শাসনের নামে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস কোনোভাবেই ক্ষমার যোগ্য নয়। যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়েছে, তাদের বিচার সামরিক ট্রাইব্যুনালের মতো বন্ধ গেটের ভেতরে নয়, বরং স্বাধীন ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে হতে হবে। এটাই ইতিহাসের দাবি, এটাই ন্যায়বিচারের দাবি।
২০২৪-এর গণহত্যার বিচার সামরিক নয়, হোক বিশেষ ট্রাইবুনালে—ন্যায়বিচারের স্বার্থে
জুলাইয়ে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের গণহত্যায় জড়িত সহযোগী সামরিক কর্মকর্তা ও সদস্যদের বিচার বিশেষ ট্রাইবুনালে করা হোক
আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের সাথে গণহত্যায় জড়িত সকল সামরিক ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা ও সদস্যদের সামরিক ট্রাইবুনালে বিচার না করে কেন বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করে বিচারকার্য সম্পাদন করা দরকার সে বিষয়ে কিছু যৌক্তিকতা প্রদর্শন করে নিজস্ব বিবৃতি দেয়া হয়েছে।
মানবিকতা বনাম বিদ্বেষ: আসিফ মাহতাবের বক্তব্য এবং আমাদের দায়

২০২৪ সালে সামাজিক মাধ্যমে একটি ভিডিও ভাইরাল হয় যেখানে আসিফ মাহতাব, একজন পরিচিত বক্তা ও ইসলাম বিষয়ক আলোচক, ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের নিয়ে একাধিক অবমাননাকর ও বৈষম্যমূলক মন্তব্য করেন। সপ্তম শ্রেনীর পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত শরীফ নামক এক বালকের শরীফা নামক বালিকায় রূপান্তরিত হওয়া বিষয়ক একটি গল্প নিয়ে তিনি চরম বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রদান করেন এবং সেই পাঠ্যবইটি তিনি জনসমক্ষে ছিড়ে ফেলেন। তার বক্তব্যে স্পষ্ট ছিল ঘৃণা, বিদ্বেষ এবং একটি মানবিক-সংবেদনশীল ইস্যুকে অবজ্ঞাসূচকভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা। এই ধরনের বক্তব্য কেবল অজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং এটি সমাজে বিদ্বেষ ও সহিংসতা উসকে দেয়ার জন্য যথেষ্ট বিপজ্জনক।
ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি কারা?
ট্রান্সজেন্ডার (transgender) ব্যক্তি সেই মানুষ, যাদের লিঙ্গ পরিচয় জন্মের সময় নির্ধারিত লিঙ্গের সঙ্গে মিল না-ও থাকতে পারে। এটি কোনো “ট্রেন্ড” নয়, বরং মানুষের পরিচয়ের গভীর এক বাস্তবতা।
✅ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ২০১৯ সালে ট্রান্সজেন্ডার পরিচয়কে আর “মানসিক ব্যাধি” হিসেবে তালিকাভুক্ত না করে এটিকে “লিঙ্গ পরিচয়ের বৈচিত্র্য” হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
➡️ সূত্র: WHO ICD-11, 2019
✅ American Psychological Association বলেছে:
“Being transgender is not a mental disorder. It is a natural variation of human experience.”
আসিফ মাহতাবের বক্তব্য কেন ক্ষতিকর?
১. ঘৃণা উসকে দেয়
ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিরা ইতিমধ্যে সমাজে চরম নিপীড়নের শিকার।
📌 Human Rights Watch এর তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় (বিশেষত বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানে) ট্রান্সজেন্ডারদের প্রতি সহিংসতা, পারিবারিক বর্জন ও অর্থনৈতিক নিপীড়ন ব্যাপকভাবে প্রচলিত।
➡️ HRW Report, 2022
২. ধর্মের অপব্যাখ্যা
ইসলামে প্রতিটি মানুষকে আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
📖 কোরআনের আয়াত (সূরা হুজুরাত, আয়াত ১৩):
“হে মানবজাতি! আমি তোমাদেরকে এক নারী ও পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পারো।”
📚 মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফতোয়া বিভাগ ২০১৬ সালে বলেছে:
“যদি কোনো ব্যক্তি ডাক্তারি ভিত্তিতে ট্রান্সজেন্ডার হন, তবে তার প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করা হারাম।”
৩. আইন ও সংবিধানবিরোধী বক্তব্য
📌 বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে হিজড়াদের “তৃতীয় লিঙ্গ” হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়
➡️ সূত্র: The Daily Star, 2013
📌 ২০১৯ সালের একটি UNDP রিপোর্ট অনুসারে, বাংলাদেশে আনুমানিক ১০,০০০+ ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি বসবাস করেন, যাদের অধিকাংশই কর্মসংস্থান, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত।
➡️ UNDP Bangladesh Report, 2019
আমাদের করণীয় কী?
✅ ঘৃণার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া
ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মধ্যে পড়ে না। এটি ঘৃণাপূর্ণ বক্তব্য (hate speech), যা সংবিধান ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে।
✅ সচেতনতা ও শিক্ষা বৃদ্ধি
📌 Pew Research Center এর 2021 সালের এক জরিপে দেখা যায়, যেসব মানুষ ট্রান্সজেন্ডারদের সম্পর্কে ঘনিষ্ঠভাবে জানেন, তাদের মধ্যে ৭৩% ট্রান্সজেন্ডার অধিকারকে সমর্থন করেন।
✅ আইনি পদক্ষেপ ও সামাজিক চাপ
ঘৃণামূলক বক্তব্যের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, এবং আইনগত বৈষম্যবিরোধী নীতিমালা ব্যবহার করে পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
শেষ কথা
আমরা কী এমন একটি সমাজ চাই, যেখানে একজন মানুষ কেবল তার পরিচয়ের কারণে ঘৃণিত হবে? যেখানে একজন আলোচক জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য মানুষের সম্মান ছিঁড়ে ফেলতে পারেন?
আসিফ মাহতাবের বক্তব্য আমাদের একটি প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে: আমরা কি মানবিকতা ও সহমর্মিতার পক্ষে, নাকি ঘৃণা ও বিভেদের পক্ষে?
আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব—ঘৃণার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, ভালোবাসা ও মানবাধিকারের পক্ষে অবস্থান নেওয়া।
মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা, ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জাতীয় নিরাপত্তা: একটি বিশ্লেষণ
বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা বহুদিন ধরেই একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাদ্রাসাভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতির একাংশ নিয়ে জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে—বিশেষ করে যখন দেখা যায় যে কিছু মাদ্রাসায় ধর্মীয় উগ্রবাদ, অসহিষ্ণুতা এবং আধুনিক জ্ঞানের প্রতি বিরূপতা ছড়িয়ে পড়ছে। এসব সমস্যা যখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়, তখন তা শুধু একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ভেতর সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং জাতীয় পর্যায়ে একটি মৌলিক সংকটের রূপ নেয়।
ধর্মীয় উগ্রবাদ কীভাবে জন্ম নেয় মাদ্রাসায়?
বাংলাদেশে মাদ্রাসা broadly দুই ধরনের: আলিয়া মাদ্রাসা এবং কওমি মাদ্রাসা। আলিয়া মাদ্রাসায় সরকার নির্ধারিত পাঠ্যক্রম অনুযায়ী ধর্মীয় এবং সাধারণ শিক্ষা দেয়া হয়, যেখানে কওমি মাদ্রাসা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারি পর্যবেক্ষণের বাইরে থেকে সম্পূর্ণ নিজস্ব পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়।
কিছু কওমি মাদ্রাসায় এমন পাঠ্যক্রম ও পরিবেশ গড়ে ওঠে যেখানে আধুনিক বিজ্ঞান, দর্শন, সমাজতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়গুলোকে অবিশ্বাস করা শেখানো হয়, এবং ভিন্নমত, ভিন্ন ধর্ম বা ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি ঘৃণা জন্মায়। ছাত্রদের শিশু বয়স থেকে শেখানো হয় যে শুধুমাত্র তাদের ধর্মীয় ব্যাখ্যা সঠিক, এবং যারা এটির বাইরে, তারা শত্রু। এই মনোভাব ধীরে ধীরে উগ্র মতাদর্শে রূপ নেয়।
জাতীয় পর্যায়ে এর প্রভাব
১. সামাজিক বিভাজন
উগ্রবাদী চিন্তা তরুণদের একঘরে করে ফেলে। তারা সমাজের অন্য অংশের মানুষকে ‘কাফের’ বা ‘ভ্রান্ত’ বলে মনে করতে শুরু করে। ফলে সমাজে সহাবস্থানের জায়গাটা সংকুচিত হয়ে পড়ে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, নারী অধিকার, বা ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাধারার প্রতি ঘৃণা বাড়তে থাকে।
২. সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি
ধর্মীয় সংকীর্ণতা থেকে যখন ‘জিহাদি’ মতাদর্শে বিশ্বাস জন্মায়, তখন সেটা অস্ত্র তুলে নেয়ার মতো পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়। বাংলাদেশে ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময়ে মাদ্রাসা-সম্পর্কিত চরমপন্থী গোষ্ঠীর নাম উঠে এসেছে যারা হামলা, হত্যা বা রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রে জড়িত।
৩. মানবসম্পদ ও শিক্ষার মান হ্রাস
যেসব শিক্ষার্থী কেবলমাত্র সংকীর্ণ ধর্মীয় ব্যাখ্যা নিয়েই বড় হয়, তাদের উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞানমনস্কতা বা কর্মজীবনে সফলতা পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। ফলে একটা বড় তরুণ জনগোষ্ঠী ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হয় না।
৪. রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর প্রতি হুমকি
বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলেও এই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা একটি সমান্তরাল ‘আইডিওলজিকাল স্টেট’ গড়ে তোলে। যেখানে রাষ্ট্রের আইন নয়, বরং ফতোয়া ও ধর্মীয় ব্যাখ্যা বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।
সমাধান কী?
- শিক্ষা সংস্কার: মাদ্রাসাগুলোকে জাতীয় পাঠ্যক্রমে আনা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা উচিত।
- উপযুক্ত মনিটরিং: ধর্মের নামে ঘৃণা, সহিংসতা বা উগ্রতা ছড়ানো হচ্ছে কিনা তা নজরদারিতে রাখা জরুরি।
- সচেতনতা বৃদ্ধি: ধর্মের মানবিক দিক, সহনশীলতা ও সহাবস্থানের বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে শেখানো উচিত।
- ইমাম ও আলেমদের প্রশিক্ষণ: আধুনিক ও মানবিক ব্যাখ্যায় ধর্ম প্রচারে আলেমদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ইতিবাচক রূপান্তর সম্ভব।
ধর্মীয় শিক্ষা কখনোই উগ্রতা বা সংকীর্ণতার বাহক হওয়া উচিত নয়। ইসলাম যেমন শান্তি ও সহনশীলতার ধর্ম, তেমনি একটি উন্নত রাষ্ট্রের মূল ভিত্তিও হলো মতের পার্থক্য মেনে চলা ও মানবিক সহাবস্থান। মাদ্রাসা শিক্ষাকে জাতীয় উন্নয়নের সহযাত্রী করতে হলে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও উগ্রবাদকে প্রতিহত করতে হবে, যুক্তিনির্ভর ও আধুনিক শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে হবে।
ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পথ ধরে — সহিংসতা থেকে মুক্তি চাই আমরা
বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ঐক্যজোটের নেতাকর্মীদের উপর মৌলবাদীদের হামলার ঘটনা দীর্ঘদিন ধরেই চলমান। এই হামলাগুলো ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিচে কিছু উল্লেখযোগ্য হামলার ঘটনা তুলে ধরা হলো:
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর মৌলবাদী হামলার চিত্র
1. হাজারী গলি সহিংসতা (নভেম্বর ২০২৪, চট্টগ্রাম)
হাজারী গলিতে একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ঘটে। পোস্টটি ইস্কনকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে উল্লেখ করেছিল, যার পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ক্ষুব্ধ হয়ে স্থানীয় মুসলিম ব্যবসায়ীর দোকানে হামলা চালায়। পুলিশ ও সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলে তাদের উপরও হামলা হয়, যার ফলে ১২ জন আহত হন। এই ঘটনায় ৮০ জনকে আটক করা হয়, যার মধ্যে ৪৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
2. নাসিরনগর সহিংসতা (অক্টোবর ২০১৬, ব্রাহ্মণবাড়িয়া)
ফেসবুকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগে নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর ব্যাপক হামলা চালানো হয়। এই সহিংসতায় ১৯টি মন্দির ও প্রায় ৩০০টি বাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়, এবং ১০০ জনেরও বেশি মানুষ আহত হন।
3. রামু সহিংসতা (সেপ্টেম্বর ২০১২, কক্সবাজার)
ফেসবুকে কোরআন অবমাননার অভিযোগে রামুতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উপর হামলা চালানো হয়। ২৪টি বৌদ্ধ মন্দির ও ৭৫টি বাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। এই সহিংসতায় প্রায় ২৫,০০০ জন অংশগ্রহণ করেছিল এবং ৩০০ জনেরও বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়।
4. সুনামগঞ্জ সহিংসতা (মার্চ ২০২১, সুনামগঞ্জ)
ফেসবুকে ইসলামি পণ্ডিত মামুনুল হকের বিরুদ্ধে আপত্তিকর মন্তব্যের অভিযোগে সুনামগঞ্জের নোয়াগাঁও গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা হয়। এই ঘটনায় ৮৮টি বাড়ি ও ৭-৮টি মন্দির ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। এই হামলার নেতৃত্ব দেন স্থানীয় যুবলীগ নেতা শাহিদুল ইসলাম স্বাধীন। এখন পর্যন্ত ৩৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
5. হাথাজারী সহিংসতা (ফেব্রুয়ারি ২০১২, চট্টগ্রাম)
হাথাজারীতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ১৪টি মন্দিরে হামলা ও লুটপাট করা হয়। এই ঘটনায় ৮০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয় এবং ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ঐক্যজোটের প্রতিরোধ ও প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্যজোট (BHBCOP) এই ধরনের হামলার বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে আসছে। তারা বিভিন্ন সময় মানববন্ধন, প্রতিবাদ সভা ও সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে হামলাকারীদের শাস্তি দাবি করেছে। তাছাড়া, রাজনৈতিক দলগুলোও এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলা বাংলাদেশের সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি। এই ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্রিয়তা এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতা প্রচারের মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন সম্ভব।
বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিক এবং বাংলাদেশে ইসলামিক মৌলবাদীদের এ নিয়ে দৃষ্টিকোণ
বাল্যবিবাহের অর্থ ও বর্তমান প্রেক্ষাপট
বাল্যবিবাহ বলতে বোঝানো হয় যখন কোনো কিশোরী বা কিশোর পারিপার্শ্বিকভাবে অপ্রাপ্ত বয়সে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অনুসারে, ১৮ বছরের নিচে হওয়া বিবাহ বাল্যবিবাহ হিসেবে গণ্য হয়। বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ একটি ব্যাপক সামাজিক সমস্যা, যেখানে বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে এর প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিকসমূহ
১. শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব
বাল্যবিবাহের ফলে কিশোরীর শরীর ও মন এখনও পূর্ণভাবে বিকশিত না হওয়ায় প্রেগন্যান্সি ও প্রসবের সময় বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়। এটি মা ও শিশুর মৃত্যুর ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। মানসিক স্তরে বাল্যবিবাহী মেয়েরা সাধারণত চাপ, দুশ্চিন্তা এবং অবসাদে ভুগে।
৩. অর্থনৈতিক সঙ্কট
বাল্যবিবাহীরা প্রায়ই স্বল্প শিক্ষিত ও অদক্ষ হওয়ায় ভালো চাকরি বা ব্যবসা করতে পারে না। ফলে পরিবারের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি হয়।
৪. নারীর অধিকার লঙ্ঘন
বাল্যবিবাহ নারীর ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও অধিকার হরণের অন্যতম কারণ। তারা প্রায়ই পারিবারিক ও সামাজিক নির্যাতনের শিকার হয়।
বাংলাদেশে ইসলামিক মৌলবাদীদের দৃষ্টিকোণ
বাংলাদেশে কিছু ইসলামিক মৌলবাদী গোষ্ঠী বাল্যবিবাহের পক্ষে অবস্থান নিতে দেখা যায়। তাদের যুক্তি প্রায়শই ধর্মীয় ও ঐতিহ্যগত ভিত্তিক হয়:
ধর্মীয় স্বীকৃতি
মৌলবাদীরা বলে থাকে, ইসলামে নির্দিষ্ট কোনো বয়সের বিধান নেই যে অনুযায়ী বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ। নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর যুগে অনেক কিশোরী অল্প বয়সে বিবাহ করেছিলেন। তাই তারা বর্তমানের আইনগত বয়স সীমা সমর্থন করে না।
ঐতিহ্য ও সামাজিক প্রথা
অনেকে বলেন, বাল্যবিবাহ গ্রামীণ ও কুসংস্কারমুক্ত সমাজ গঠনের অংশ, যেখানে মেয়েদের নিরাপত্তা ও সম্মানের জন্য এ ধরনের বিবাহ প্রয়োজনীয়।
অর্থনৈতিক কারণ
কিছু মৌলবাদী গোষ্ঠী বাল্যবিবাহকে দরিদ্র পরিবারের জন্য আর্থিক বোঝা কমানোর উপায় হিসেবেও দেখে।
আধুনিক সমাজ ও মানবাধিকার দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যা
অন্যদিকে, দেশের আধুনিক ও মানবাধিকার কর্মীরা বাল্যবিবাহকে নারীর মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন হিসেবে দেখে। তারা বলছেন:
- বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ধর্মীয় শিক্ষাবিদ ও নেতৃবৃন্দের সহায়তা প্রয়োজন।
- ধর্ম ও ঐতিহ্যের নামে নারীর স্বতন্ত্র উন্নয়ন বন্ধ করা উচিত নয়।
- শিক্ষার প্রসার ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি বাল্যবিবাহ রোধে কার্যকরী হাতিয়ার।
সমাধানের পথ
বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ রোধে দরকার সমন্বিত প্রচেষ্টা:
- শিক্ষা প্রসার
মেয়েদের স্কুলে ভর্তি ও শিক্ষাজীবন দীর্ঘ করার উদ্যোগ নিতে হবে। - আইনি ব্যবস্থা কঠোর করা
বাল্যবিবাহের জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ জরুরি। - ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্ততা
ইসলামী শিক্ষাবিদদের সচেতন করে, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিক বোঝানো দরকার। - সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি
মিডিয়া ও সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে বাল্যবিবাহের বিপর্যয় জনসমক্ষে আনা জরুরি।
বাল্যবিবাহ বাংলাদেশের একটি গভীর সামাজিক সমস্যা, যার প্রভাব মেয়েদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অধিকার ও ভবিষ্যত জীবনকে প্রভাবিত করে। ইসলামিক মৌলবাদীরা ধর্মীয় ও ঐতিহ্যগত যুক্তিতে বাল্যবিবাহ সমর্থন করলেও আধুনিক সমাজ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো এটি বন্ধে কাজ করে যাচ্ছে। সমগ্র জাতির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাল্যবিবাহের অভিশাপ থেকে দেশকে মুক্ত করা সম্ভব।
বাংলাদেশে ডমেস্টিক ভায়োলেন্স: নীরবতার দেয়াল ভাঙার সময় এখন
ডমেস্টিক ভায়োলেন্স কী?
ডমেস্টিক ভায়োলেন্স বলতে পারিবারিক পরিসরে সংঘটিত যে কোনো ধরণের নির্যাতন বোঝায়—শারীরিক, মানসিক, যৌন, আর্থিক কিংবা ডিজিটাল সহিংসতা—যা সাধারণত একজন পরিবারের সদস্য অপর সদস্যের ওপর প্রয়োগ করে।
বাংলাদেশে ডমেস্টিক ভায়োলেন্সের পরিসংখ্যান
বাংলাদেশে গার্হস্থ্য সহিংসতা একটি উদ্বেগজনক সমস্যা। বিভিন্ন গবেষণা ও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে নীচের তথ্যগুলো:
- বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস (BBS) ২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী:
বিবাহিত নারীদের প্রায় ৭২.৬% জীবনের কোনো না কোনো সময়ে স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। - ব্র্যাকের ২০২০ সালের এক জরিপে দেখা গেছে:
করোনাকালীন সময়ে গার্হস্থ্য সহিংসতার হার ৬৯% বৃদ্ধি পেয়েছে। - Ain o Salish Kendra (ASK)–এর তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালে শুধু সংবাদপত্রের ভিত্তিতে রিপোর্ট হওয়া নারী নির্যাতনের ঘটনা ছিল ১,৩৭৫টি, যার মধ্যে অনেক ঘটনাই ছিল ডমেস্টিক ভায়োলেন্স।
আইনি কাঠামো ও প্রতিরক্ষা
বাংলাদেশে ডমেস্টিক ভায়োলেন্স রোধে আইনগত ব্যবস্থাও রয়েছে:
✅ “নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০”
- ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন ও যৌতুক সংক্রান্ত সহিংসতার জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে।
✅ “ডমেস্টিক ভায়োলেন্স (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০”
- এ আইনে মানসিক, শারীরিক, যৌন এবং আর্থিক নির্যাতনকে ডমেস্টিক ভায়োলেন্স হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
- ভুক্তভোগী নারীরা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে গিয়ে “সুরক্ষা আদেশ” পেতে পারেন।
✅ জেন্ডার সেল, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়
- নির্যাতনের শিকার নারীদের সহায়তা ও পুনর্বাসনে কাজ করে।
সমাজের মনোভাব ও প্রতিবন্ধকতা
বাংলাদেশে এখনো অনেক মানুষ ডমেস্টিক ভায়োলেন্সকে “পারিবারিক বিষয়” বলে চুপ থাকেন। সামাজিক লজ্জা, আর্থিক নির্ভরতা, সন্তানদের ভবিষ্যৎ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বল প্রতিক্রিয়া—এসব কারণে নির্যাতিতরা ন্যায়বিচার পান না।
সহায়তার মাধ্যম
- ১০৯: জাতীয় সহায়তা হেল্পলাইন (২৪/৭ চালু)
- BRAC, ASK, BNWLA প্রভৃতি এনজিও প্রতিষ্ঠান সহায়তা প্রদান করে থাকে।
- নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র ও সেফ শেল্টার-এ আশ্রয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।
করণীয় ও সুপারিশ
- সচেতনতা বৃদ্ধি: স্কুল, কলেজ ও কমিউনিটি পর্যায়ে ডমেস্টিক ভায়োলেন্স সম্পর্কে শিক্ষা দিতে হবে।
- নারীর আর্থিক স্বাধীনতা: অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলে নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা সহজ হয়।
- আইন প্রয়োগে স্বচ্ছতা: পুলিশের ভূমিকাকে জবাবদিহিমূলক করতে হবে।
- সামাজিক নিরাপত্তা জাল বিস্তার: সাইকোসোশিয়াল কেয়ার, লিগ্যাল এইড ও হেল্পলাইন আরও বিস্তৃত করতে হবে।
ডমেস্টিক ভায়োলেন্স কোনো ব্যক্তিগত বিষয় নয়, এটি একটি সামাজিক অপরাধ। এর বিরুদ্ধে শুধু আইন নয়, দরকার সামাজিক সচেতনতা, শিক্ষা, এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ। আমরা যদি এই সমস্যাটিকে লুকিয়ে রাখি, তাহলে এটি আরও গভীর হয়। এখনই সময় কথা বলার, সাহসী হওয়ার এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর।
বাংলাদেশে নারীদের মোরাল পুলিসিং: বাস্তবতা, প্রভাব ও উত্তরণের পথ
বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীদের প্রতিদিনই লড়তে হয় নানা ধরনের সামাজিক বিধিনিষেধ, মনোভাব এবং আচরণের বিরুদ্ধে। এসবের মধ্যে অন্যতম হলো মোরাল পুলিসিং — এক ধরনের অঘোষিত সামাজিক পুলিশি তৎপরতা, যার মাধ্যমে নারীদের চলাফেরা, পোশাক, কথা বলা, এমনকি অনলাইন কার্যক্রম পর্যন্ত ‘নৈতিকতা’র ছাঁকনি দিয়ে বিচার করা হয়।
মোরাল পুলিসিং কী এবং এটি কোথা থেকে আসে?
মোরাল পুলিসিং মূলত এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজেদের ‘নৈতিক মাপকাঠি’র মানদণ্ডে অন্যের জীবনযাপন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। বাংলাদেশে এটি বেশিরভাগ সময় নারীদের ক্ষেত্রেই প্রয়োগ হয়। রাস্তাঘাটে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সামাজিক মাধ্যমে — সব জায়গাতেই নারীদের পোশাক, ব্যবহার, বন্ধুতা, এমনকি কর্মক্ষেত্রে কাজ করার ধরন নিয়ে মন্তব্য, তিরস্কার বা হেনস্তার শিকার হতে হয়।
এই মানসিকতা এসেছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, ধর্মীয় অপব্যাখ্যা, এবং সংস্কৃতির নামে রক্ষণশীল মানসিকতা থেকে। অনেক সময় গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যম এই প্রবণতাকে আরও উসকে দেয়।
মোরাল পুলিসিংয়ের প্রভাব
- মানসিক চাপ ও আত্মবিশ্বাসে আঘাত – বারবার মন্তব্য ও হেনস্তা নারীদের আত্মসম্মানে আঘাত হানে।
- স্বাধীন চলাফেরার সীমাবদ্ধতা – নারীরা নিজের পছন্দমতো পোশাক বা পরিবেশে চলতে ভয় পায়।
- শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে বাধা – অনেক নারী শুধুমাত্র সামাজিক মানসিকতার ভয়ে বাইরে কাজ করতে চান না।
- সাইবার বুলিং – সামাজিক মাধ্যমে নারীপ্রোফাইল লক্ষ্য করে ‘শালীনতা’র দোহাই দিয়ে আক্রমণ করা হয়।
কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
১. আইনি পদক্ষেপ জোরদার করা
মহিলা ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ বিদ্যমান আইনগুলো কার্যকরভাবে প্রয়োগ করলে অনলাইন এবং অফলাইনে হেনস্তাকারীদের শাস্তির মুখোমুখি করা সম্ভব। পুলিশ প্রশাসনের নারীবান্ধব আচরণও জরুরি।
২. জনসচেতনতা তৈরি
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে লিঙ্গ সমতা, মানবাধিকার ও নাগরিক চেতনা বিষয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালু করা যেতে পারে। মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়াকে ইতিবাচক বার্তা প্রচারে ব্যবহার করা উচিত।
৩. নারীর নিজস্ব কণ্ঠস্বর জোরালো করা
নারীদের কথা বলার জায়গা তৈরি করতে হবে — যেমন ব্লগ, ইউটিউব চ্যানেল, পডকাস্ট, কর্মশালা। যখন নারী নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেয়, তখন তা অন্য নারীর জন্য প্রেরণাদায়ী হয়ে ওঠে।
৪. পুরুষদের সম্পৃক্ত করা
এটা কেবল নারীর লড়াই নয়। পিতৃতন্ত্রের অবসান ঘটাতে হলে পুরুষদেরও দায়িত্ব নিতে হবে। পুরুষদের মধ্যে সহানুভূতি, সমতা ও সহমর্মিতা বাড়াতে কাজ করতে হবে পরিবার ও শিক্ষাঙ্গনে।
৫. সোশ্যাল মিডিয়া রিপোর্টিং ও কাউন্টার ন্যারেটিভ
সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রল বা হেনস্তাকারীদের রিপোর্ট করে এবং গঠনমূলক পোস্টের মাধ্যমে ‘কাউন্টার ন্যারেটিভ’ দাঁড় করিয়ে মোরাল পুলিসিং-এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়া সম্ভব।
মোরাল পুলিসিং সমাজে নারী-পুরুষের বৈষম্যকে আরও গভীর করে তোলে। এটি বন্ধ করতে হলে চাই আইনি কাঠামোর বাস্তব প্রয়োগ, সামাজিক চিন্তার পরিবর্তন, এবং নারী-পুরুষ উভয়ের সচেতন অংশগ্রহণ। ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং নারীর মর্যাদা রক্ষা করা শুধু নারীর অধিকার নয়, এটি একটি সভ্য ও মানবিক সমাজের অন্যতম ভিত্তি।
ধর্মীয় অরাজগতায় রাজনীতির ভূমিকা: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও, দেশটির ইতিহাস, রাজনীতি এবং সামাজিক কাঠামোর সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই জটিল ও সংবেদনশীল। ধর্মীয় অনুভূতিকে কেন্দ্র করে সময় সময় দেশে যে অরাজকতা সৃষ্টি হয়, তার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও প্রভাব অনস্বীকার্য। এ ব্লগে আলোচনা করা হবে বাংলাদেশের ধর্মীয় অরাজগতায় রাজনীতির কী ভূমিকা রয়েছে এবং কীভাবে এটি সমাজে বিভাজন ও অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।
১. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের জন্ম (১৯৭১) হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতাকে ভিত্তি করে, যেখানে সব ধর্মের মানুষের জন্য সমান অধিকার ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছিল। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা যুক্ত থাকলেও, ১৯৭৫-এর পর বিভিন্ন সামরিক ও রাজনৈতিক সরকারের সময়কাল ধর্মীয় রাজনীতির প্রতি নমনীয়তা ও উৎসাহ দেখা যায়।
১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান ইসলামী দলসমূহের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন এবং ১৯৮৮ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন — এই ঘটনাগুলো ধর্মীয় রাজনীতিকে মূলধারায় প্রতিষ্ঠিত করে।
২. রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের ব্যবহার
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মকে অনেক সময় ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে ধর্মীয় সংগঠন কিংবা নেতাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়, যা ধর্মকে রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করে। এই ধরনের দৃষ্টান্ত দেখা গেছে:
- হেফাজতে ইসলামের উত্থান ও রাজনৈতিক প্রভাব: ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরের ঘটনার পর থেকে হেফাজত ইসলাম একটি প্রভাবশালী ধর্মীয় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বিভিন্ন সময় সরকার এই সংগঠনের সঙ্গে আপস করেছে, যা তাদের দাবি ও কর্মকাণ্ডকে আরও জোরদার করেছে।
- ব্লগার হত্যা ও মুক্তচিন্তার দমন: ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে একাধিক মুক্তমনা ব্লগার ও লেখককে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে হত্যা করা হয়। এসব ঘটনার পেছনে ধর্মীয় উগ্রবাদ যেমন দায়ী, তেমনি রাজনীতিকদের নীরবতা বা পরোক্ষ সমর্থন এসব হত্যাকে উসকে দিয়েছে।
৪. রাজনীতির দ্বিমুখিতা ও রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়া
ধর্মীয় সহিংসতা বা উগ্রতা রোধে রাষ্ট্র বা সরকার একদিকে সহনশীলতার কথা বললেও, অন্যদিকে রাজনৈতিক চাপ বা স্বার্থে জড়িত গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়। ফলে ধর্মীয় মৌলবাদীরা উৎসাহিত হয়, এবং জনগণের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয়।
৫. সমাধানের পথ
ধর্মীয় অরাজকতা রোধে রাজনীতির দায়িত্বশীল ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি। কিছু করণীয় হতে পারে:
- ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করা
- সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা
- ধর্মীয় উগ্রতা রোধে কঠোর আইন প্রয়োগ
- শিক্ষা ও গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা
- বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা
বাংলাদেশে ধর্মীয় অরাজগতা নিছক ধর্মীয় বিশ্বাসের ফল নয়; এর পেছনে রাজনৈতিক হিসাব, শক্তির খেলা এবং ক্ষমতার লোভ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ধর্মীয় অনুভূতিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বন্ধ না হলে সমাজে বিভাজন, ঘৃণা ও সহিংসতা আরও বৃদ্ধি পাবে। একটি বাস্তবিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক সংস্কৃতিই পারে এই অরাজকতা থেকে জাতিকে রক্ষা করতে।
ধর্মের আগে মানুষ: মানবতার সর্বোচ্চ মূল্যবোধ
আমরা মানুষ। আমাদের জন্ম হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান বা বৌদ্ধ হয়ে নয়—মানুষ হয়ে। ধর্ম আমাদের পরিচয়ের একটি অংশ হলেও, সেটি আমাদের মানবিকতার উপরে নয়। দুর্ভাগ্যবশত, আজকের সমাজে ধর্মকে মানুষ ও মানবতার চেয়ে বড় করে দেখা হচ্ছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধুমাত্র বিভাজন সৃষ্টি করে না, বরং মানুষের মূল গুণ—সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও সহানুভূতির—অবমূল্যায়ন ঘটায়।
১. মানুষই ধর্ম সৃষ্টি করেছে, ধর্ম মানুষকে নয়
ধর্ম এসেছে মানুষের নৈতিকতা, সমাজগঠন এবং আত্মিক প্রশান্তির প্রয়োজনে। যুগে যুগে বিভিন্ন ধর্ম মহান মানবিক মূল্যবোধের ওপর দাঁড়িয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই ধর্মের উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষকে সঠিক পথে চালিত করা, কোনোভাবেই মানবতাকে চাপা দেওয়া নয়। যদি কোনো ধর্মীয় চর্চা বা ব্যাখ্যা মানুষের প্রতি ঘৃণা, সহিংসতা বা বৈষম্য তৈরি করে—তাহলে তা ধর্ম নয়, মানুষের ভুল ব্যাখ্যা।
২. মানবতা সব ধর্মের মূল শিক্ষা
প্রতিটি ধর্মই মানুষকে ভালোবাসতে, অন্যের পাশে দাঁড়াতে এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের শিক্ষা দেয়।
- ইসলাম বলে: “তোমরা একে অপরকে সাহায্য করো ন্যায়ের ও সদাচরণের কাজে।”
- হিন্দুধর্মে আছে: “অহিংসা পরম ধর্ম।”
- খ্রিস্টধর্মে বলা হয়: “তোমার প্রতিবেশীকে নিজের মতো ভালোবাসো।”
- বৌদ্ধ ধর্মে অহিংসা ও দয়া হচ্ছে মূল ভিত্তি।
তবে, যখন ধর্মীয় পরিচয় আমাদেরকে বিভক্ত করে ফেলে, তখন আমরা বুঝতে পারি, মানবতা হারিয়ে যাচ্ছে।
৩. ধর্ম মানুষকে বিভক্ত করতে নয়, একত্র করতেই ছিল
একজন দরিদ্র মানুষকে ধর্ম অনুযায়ী সাহায্য না করে উপেক্ষা করলে, সেটা কি ধর্মীয় আচরণ? একজন আহত মানুষ রাস্তায় পড়ে আছে—সে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান কি জিজ্ঞাসা করার আগে কি আমরা মানুষ হিসেবে দায়িত্ববোধ দেখাতে পারি না? একটি শিশুর কান্না শুনে আমরা তার ধর্ম জিজ্ঞাসা করি না—আমরা এগিয়ে যাই, কারণ সেটা মানবতা। এই সহজ সত্যই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়—মানবতা আগে, তারপর ধর্ম।
৪. ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে মানবিক পরিচয় বড়
পৃথিবী আজ যুদ্ধ, সাম্প্রদায়িকতা, ঘৃণা আর বিভাজনে জর্জরিত। এ অবস্থায় আমাদের প্রয়োজন এমন মানুষ, যারা আগে মানুষ হিসেবে ভাববে, তারপর ধর্মীয় পরিচয় অনুযায়ী। যে ব্যক্তি অন্যকে ভালোবাসতে জানে, দয়া দেখাতে জানে, সে-ই প্রকৃত ধার্মিক—ধর্মগ্রন্থ মুখস্থ জানা কিংবা আচার পালন নয়।
৫. মানবতা ব্যতীত ধর্ম একটি খোলস মাত্র
ধর্ম তখনই মহৎ যখন তা মানুষকে আরও উদার, সহনশীল ও সহানুভূতিশীল করে তোলে। যদি কোনো ধর্মীয় চর্চা মানবতাবিরোধী হয়ে পড়ে, তবে সেটি ধর্ম নয়—তা হচ্ছে গোঁড়ামি। একটা গোঁড়া মন যা অন্যকে আঘাত করে, ঘৃণা ছড়ায় বা অন্য মতকে সহ্য করতে পারে না, তা কোনো ধর্মই সমর্থন করে না।
আজ আমাদের সবচেয়ে প্রয়োজন সহানুভূতিশীল, মানবিক মানুষ। ধর্মীয় পরিচয়ের আগেই আমরা যেন নিজেকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলি। ধর্ম হোক আত্মিক পথচলার উপায়—মানবতা হোক তার ভিত্তি। ধর্মের আগে মানুষ—এই বোধ যত বিস্তৃত হবে, তত শান্তিময় হবে সমাজ, বিশ্ব, এবং আমাদের ভবিষ্যৎ।