বাংলাদেশে নারী স্বাধীনতার প্রশ্নটি নিছক নারী-পুরুষ সমতার ধারণায় সীমাবদ্ধ নয়। এটি গভীরভাবে যুক্ত একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রক্রিয়ার সঙ্গে, যেখানে রাষ্ট্র, সমাজ এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর ভূমিকাকে উপেক্ষা করা যায় না। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক সংঘটনগুলো, বিশেষ করে বাংলাদেশে, বরাবরই নারী স্বাধীনতা প্রশ্নে একটি নির্দিষ্ট অবস্থান থেকে কথা বলে এসেছে—যা অনেক সময় নারী অধিকারের ধারণার সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক হয়েছে।
বাংলাদেশের নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার যাত্রা শুরু হয় বহু আগেই, বৃটিশ শাসনামলের শেষ দিকে। তখনকার সমাজে নারী শিক্ষা এবং পর্দাপ্রথা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল। সেই ধারারই অগ্রগামী ছিলেন বেগম রোকেয়া, যিনি ধর্মের ছাঁদ না ভেঙেই নারী জাগরণকে সামনে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে এসে আমরা দেখি, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলো অনেকাংশে রোকেয়ার বিপরীত সুরে কথা বলে। তারা নারীকে একটি ধর্মীয় কাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ রাখতে চায়, যেখানে স্বাধীন মতপ্রকাশ, পোশাকের স্বাধীনতা কিংবা পেশাগত অংশগ্রহণ প্রায়শই প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশে নারীর অংশগ্রহণ যুদ্ধকাল থেকেই স্পষ্ট। তারা চিকিৎসা দিয়েছে, অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে, শরণার্থী শিবিরে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু যুদ্ধশেষে নারীদের এই অবদান যেভাবে অবমূল্যায়িত হয়েছে, তা পরিষ্কারভাবে বলে দেয়—এই রাষ্ট্র তখনো নারীকে পূর্ণাঙ্গ নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত ছিল না। যুদ্ধকালীন ধর্ষণের শিকার নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ ঘোষণা করলেও বাস্তবে তারা অনেকেই সামাজিকভাবে বর্জিত, অবহেলিত ও নিঃস্ব ছিলেন।
স্বাধীনতার কিছু বছর পর, যখন বাংলাদেশ সামরিক শাসনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তখন আবার ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্রীয় রাজনীতিতে প্রবেশাধিকার পেতে শুরু করে। ১৯৮৮ সালে যখন ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়, তখন থেকে এক ধরনের মৌলবাদী ভাষ্য রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রবেশ করতে শুরু করে। নারীর পোশাক, কর্মজীবনে উপস্থিতি কিংবা শিক্ষার অধিকার এই ভাষ্যের প্রধান টার্গেট হয়ে ওঠে। হেফাজতে ইসলাম নামক সংগঠনটি ২০১৩ সালে প্রকাশ্যে নারীদের ‘অবাধ চলাফেরা’, ‘অপশালীনতা’ এবং ‘অমুসলিম আদলে’ জীবন যাপনের বিরুদ্ধে ১৩ দফা দাবি তোলে। তারা সরাসরি নারীর ঘরের বাইরে কাজ নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব দেয় এবং নারীদের জন্য বাধ্যতামূলক হিজাবের কথা বলে।
এই ধরনের দাবিগুলোর প্রভাব সরাসরি নারীর প্রতি সামাজিক মনোভাবকে প্রভাবিত করে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নারীর গৃহে অবস্থান করাকে শ্রেষ্ঠত্বের পর্যায়ে তুলে ধরার ফলে অনেক জায়গায় নারীরা শিক্ষা, চিকিৎসা বা কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণে নিরুৎসাহিত হন। বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে অনেক মাদ্রাসা বা ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারীর শিক্ষা সীমিত রাখা হয়, যেখানে পবিত্রতা ও পর্দাকে অতিরঞ্জিতভাবে প্রচার করা হয়। অথচ এই দেশের রাষ্ট্রীয় নীতিমালাই বলে, নারী ও পুরুষ সমানভাবে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে।
অবশ্য, এর বিপরীতে একটি সচেতন, শিক্ষিত ও প্রতিবাদী নারী সমাজও গড়ে উঠেছে, যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে তাদের অধিকার খর্ব করার বিপক্ষে সোচ্চার। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, নারীপক্ষ, ব্লাস্টসহ বহু নারী সংগঠন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দাবির বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে, বিবৃতি দিয়েছে এবং আইনি লড়াই লড়েছে। তারা স্পষ্ট করে দিয়েছে, ধর্ম কখনো নারীর অধিকার দমন করার অস্ত্র হতে পারে না।
তবে বিষয়টি শুধু দ্বান্দ্বিক নয়। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের অনেক নারী এখন এক নতুন ধারার চিন্তায় বিশ্বাসী—যা ধর্ম ও আধুনিকতা, উভয়কে একসাথে ধারণ করতে চায়। এই নারীরা হয়তো বোরকা বা হিজাব পরেন, কিন্তু একই সাথে তাঁরা শিক্ষকতা করেন, ডাক্তার হন, রাজনীতিতে অংশ নেন, এমনকি মাঠ পর্যায়ে কৃষিকাজেও অংশ নিচ্ছেন। এই ধারাটি ধর্মীয় অনুশাসনের ভেতর থেকেও নারী স্বাধীনতার জায়গা খুঁজে নেওয়ার এক প্রয়াস।
বাংলাদেশের সমাজ এখন এক দ্বৈত বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে নারী তার যোগ্যতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে—বিমান উড়াচ্ছে, সংসদে আইন প্রণয়ন করছে, আন্তর্জাতিক ক্রীড়ায় পদক জিতছে। অন্যদিকে এখনো অনেক ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠী নারীর স্বাধীনতাকে “নৈতিক বিপর্যয়” বলে আখ্যায়িত করছে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে।
এই দ্বৈত চিত্রের মধ্যে থেকে উত্তরণের পথ একটাই—সমাজকে বুঝতে হবে, নারী স্বাধীনতা ধর্মের বিপক্ষে নয়, বরং মানুষের মর্যাদার প্রশ্ন। রাষ্ট্রকেই এই সংকটে নিরপেক্ষ ও ন্যায্য ভূমিকা পালন করতে হবে, যেখানে একজন নারী তার পোশাক, পেশা ও মত প্রকাশের ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ধর্ম হোক তার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, কিন্তু তা যেন কোনোভাবেই তার অধিকার ও সম্ভাবনার সীমা না নির্ধারণ করে। বাংলাদেশের অগ্রগতি তখনই পূর্ণতা পাবে, যখন নারীকে শুধু একজন অনুসারী নয়, বরং সমাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে।