সমলিঙ্গ প্রেম ও বিবাহ বিষয়টি বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও, বাংলাদেশে এখনো এটি এক গভীর সামাজিক ও আইনি ট্যাবু। গে ও লেসবিয়ান (সমলিঙ্গ) কাপলদের মধ্যে ভালোবাসা, একসাথে থাকার আকাঙ্ক্ষা কিংবা আইনি বিয়ের চিন্তাও এখানে অনেক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়। এই ব্লগে আমরা বিশ্লেষণ করব, কেন বাংলাদেশে সমলিঙ্গ বিয়ে এখনো আইনসিদ্ধ নয়, এই পথে কী কী বাধা রয়েছে, এবং সমাজ কিভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়।
আইনি বাধা
বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, সমলিঙ্গ বিবাহ স্বীকৃত নয়। মূলত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে প্রণীত দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৩৭৭ ধারা এখনো বলবৎ রয়েছে, যা “অপ্রাকৃতিক যৌন সম্পর্ক”কে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। যদিও এই ধারাটি সরাসরি বিয়ের বিষয়ে নয়, তবে এটি সমলিঙ্গ সম্পর্ককে অপরাধ হিসেবে গণ্য করায় বিয়ের পথ একপ্রকার বন্ধ করে দেয়।
৩৭৭ ধারা অনুযায়ী:
- সমলিঙ্গ যৌন সম্পর্কের জন্য শাস্তি হতে পারে আজীবন কারাদণ্ড অথবা ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড।
বাংলাদেশের সংবিধান ‘সাম্যের’ কথা বললেও, এটি শুধুমাত্র লিঙ্গ, ধর্ম ও জাতিগত পরিচয় অনুযায়ী। যৌন পরিচিতি বা যৌন প্রবণতা সংক্রান্ত অধিকার স্পষ্টভাবে স্বীকৃত নয়।
সামাজিক বাধা
বাংলাদেশে সমাজ এখনো গভীরভাবে রক্ষণশীল ও ধর্মীয় মূল্যবোধপ্রধান। ফলে, সমলিঙ্গ সম্পর্কের ধারণাটিই সমাজের অধিকাংশ মানুষের কাছে অগ্রহণযোগ্য।
প্রধান সামাজিক বাধাগুলো:
- ধর্মীয় অনুশাসন:
ইসলাম, যা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্ম, সমলিঙ্গ সম্পর্ককে পাপ এবং হারাম হিসেবে বিবেচনা করে। একই ধরণের অবস্থান হিন্দু, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মগুলোতেও বিদ্যমান। - পারিবারিক চাপ ও বাধা:
একজন সমলিঙ্গ প্রেমিক বা প্রেমিকা যখন তাদের সম্পর্ক প্রকাশ করতে চান, তখনই পরিবারের পক্ষ থেকে চরম বিরোধিতা, মানসিক চাপ এমনকি জোরপূর্বক বিয়ের চেষ্টা হয়।
সমাজের লাঞ্ছনা ও হয়রানি:
- “শ্রেণিচ্যুতি” (social exclusion)
- কটুক্তি, হেনস্থা, এমনকি সহিংসতার শিকার হওয়া
- কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য ও চাকরি হারানোর ঝুঁকি
প্রতিক্রিয়া ও মনোভাব
বাংলাদেশে অধিকাংশ মানুষ এখনো সমলিঙ্গ সম্পর্ক নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতে অনিচ্ছুক। যারা এ বিষয়ে কথা বলেন বা অধিকার দাবি করেন, তারা প্রায়ই হয়রানির শিকার হন।
গবেষণা ও বাস্তব অভিজ্ঞতা অনুযায়ী:
- এলজিবিটি (LGBTQ+) সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাদের যৌন পরিচয় গোপন রাখতে বাধ্য হন।
- শহরাঞ্চলে কিছু তরুণ সমাজ অপেক্ষাকৃত উদার হলেও, গ্রাম বা ছোট শহরে প্রতিক্রিয়া হয়ে ওঠে চরম বিরূপ।
প্রতিরোধ ও সচেতনতা বৃদ্ধি
যদিও পরিস্থিতি জটিল, কিছু সংস্থা ও মানবাধিকার কর্মী এই বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে কাজ করছেন। উদাহরণস্বরূপ:
- বেসরকারি সংগঠন (NGO) গুলো লুকিয়ে এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানসিক সহায়তা দিয়ে থাকে।
- কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবং ব্লগ লেখার মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করছে।
তবে এখনও রাষ্ট্রীয় বা জনপর্যায়ে কোনও বৃহৎ উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায় না।
বাংলাদেশে গে এবং লেসবিয়ান কাপলদের বিয়ে কেবল সামাজিক স্বীকৃতির অভাবেই নয়, আইনি প্রতিবন্ধকতার কারণেও এক কঠিন বিষয়। সমকামী মানুষদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত এই পথ রুদ্ধই থেকে যাবে। তবে পরিবর্তন অসম্ভব নয় — সচেতনতা, শিক্ষা এবং তরুণ সমাজের মনোভাব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।