বাংলাদেশে সমকামী সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব বহু পুরোনো হলেও, এ বিষয়ে প্রকাশ্য আলোচনা, সামাজিক স্বীকৃতি কিংবা আইনি সুরক্ষা প্রায় অনুপস্থিত। ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রক্ষণশীলতার কারণে সমকামিতা এখনও এখানে ‘ট্যাবু’ বা নিষিদ্ধ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়। এই প্রেক্ষাপটে, সমকামী মানুষদের প্রতি সহিংসতা, হয়রানি এবং সামাজিক বর্জনের ঘটনাগুলো প্রায়ই আড়ালে থেকে যায় বা উপেক্ষিত হয়।
আইনি অবস্থা
বাংলাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের আইন দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ধারা ৩৭৭ এখনো বহাল আছে, যা ‘অপ্রাকৃতিক যৌনাচার’ নিষিদ্ধ করে। এই ধারায় সমকামী যৌন সম্পর্ককে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়, যার সর্বোচ্চ শাস্তি আজীবন কারাদণ্ড। যদিও এই ধারায় খুব কম মামলা হয়েছে, তবে এটি সমকামী জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বৈষম্য ও সহিংসতা বৈধ করার একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
সহিংসতার চিত্র
১. প্রকাশ্য হত্যাকাণ্ড
২০১৬ সালে ঢাকায় ভয়াবহ একটি ঘটনা ঘটে: জুলহাজ মান্নান এবং তার বন্ধু মাহবুব রাব্বি তনয়কে কুপিয়ে হত্যা করে ইসলামপন্থি জঙ্গিরা। জুলহাজ ছিলেন ইউএস এইড-এর কর্মী এবং বাংলাদেশের প্রথম LGBTQ ম্যাগাজিন Roopbaan-এর সম্পাদক। এই হত্যাকাণ্ড ছিল বাংলাদেশের সমকামী সম্প্রদায়ের ওপর সরাসরি এক নৃশংস আঘাত।
২. পুলিশি হয়রানি ও গ্রেফতার
২০১৭ সালে ঢাকা শহরের কেরানীগঞ্জে এক ‘সামাজিক জমায়েত’-এর সময় সমকামী সন্দেহে ২৭ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে কোন নির্দিষ্ট অপরাধের অভিযোগ ছিল না, কিন্তু ‘নৈতিক অবক্ষয়’ এবং ‘সমাজবিরোধী কাজ’-এর অভিযোগে তাদের আটক করা হয়।
৩. সামাজিক বর্জন ও মানসিক নির্যাতন
অনেক এলজিবিটি ব্যক্তি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন এবং মানসিক নির্যাতন ও আত্মহত্যার ঝুঁকিতে থাকেন। অনেকে বাধ্য হয়ে সমাজের চোখে অদৃশ্য হয়ে যান বা দেশ ছাড়ার চেষ্টা করেন।
মিডিয়া ও জনমত
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমে এলজিবিটি সংক্রান্ত যেকোনো আলোচনার প্রতিক্রিয়া বেশিরভাগ সময় নেতিবাচক। ধর্মীয় অনুভূতি ও ‘পাশ্চাত্য সংস্কৃতি’র ভয়কে উসকে দিয়ে সমকামীতা বিরোধী মনোভাবকে পোক্ত করা হয়। ফলে সচেতনতা বৃদ্ধির সুযোগ সীমিত থাকে।
সাহসী কণ্ঠ ও প্রতিবাদ
যদিও ভয় ও নির্যাতনের মধ্যে, কিছু সাহসী মানুষ ও সংগঠন (যেমন Boys of Bangladesh, Roopbaan) সমানাধিকারের দাবিতে সোচ্চার থেকেছে। তারা সচেতনতা বৃদ্ধি, মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা এবং আইনি সংস্কারের দাবিতে কাজ করেছে। তবে রাষ্ট্রীয় চাপ ও নিরাপত্তার অভাবে অনেকেই কার্যক্রম বন্ধ বা সীমিত করতে বাধ্য হয়েছেন।
বাংলাদেশে সমকামীদের প্রতি সহিংসতা শুধুমাত্র আইন কিংবা ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নয়, বরং এটি সামাজিক অজ্ঞতা, ভয়, ও রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাবের প্রতিফলন। একটি সভ্য ও মানবিক সমাজ গঠনের জন্য প্রয়োজন বৈচিত্র্যকে মেনে নেওয়ার মানসিকতা এবং প্রতিটি মানুষের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার অঙ্গীকার।