March 27, 2025

Banner Image

বিচিন্তা

বিবর্তন সম্পর্কে সাধারণ ভুল ধারণা ও তাদের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা

বিবর্তন হচ্ছে জীববিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং সুপ্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব, যা জীবজগতের বৈচিত্র্য ব্যাখ্যা করে। এটি বহু শতাব্দীর গবেষণা, পর্যবেক্ষণ ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে, এই তত্ত্ব নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করে। এসব ভুল ধারণা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুল ব্যাখ্যা, অসম্পূর্ণ তথ্য, অথবা বিজ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞতা থেকে আসে। এই লেখায় বিবর্তন সম্পর্কে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা ও তাদের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বিশদভাবে আলোচনা করা হবে। 

১. “বিবর্তন শুধুমাত্র একটি তত্ত্ব, তাই এটি নিশ্চিত সত্য নয়” 

অনেকেই মনে করেন, যেহেতু বিবর্তনকে “তত্ত্ব” বলা হয়, তাই এটি শুধুমাত্র একটি অনুমান বা ধারণা। কিন্তু বিজ্ঞানের ভাষায় “তত্ত্ব” (Theory) শব্দের অর্থ ভিন্ন। সাধারণ কথাবার্তায় “তত্ত্ব” বলতে আমরা অনেক সময় অনুমান বা কল্পনার কথা বুঝি, যেমন—“আমার তত্ত্ব হলো আজ বৃষ্টি হবে।” কিন্তু বিজ্ঞানীদের কাছে “তত্ত্ব” মানে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ও বহুবার পরীক্ষিত ব্যাখ্যা, যা পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষার ফলাফল এবং প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে গঠিত হয়েছে। 

বিবর্তন তত্ত্বটি বহু গবেষণা ও প্রমাণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটি মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব, কোয়ান্টাম তত্ত্ব বা আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মতোই শক্তিশালী ও বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত। ডিএনএ বিশ্লেষণ, জীবাশ্ম রেকর্ড, প্রাণীর শারীরিক গঠন ও জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে বিবর্তন সম্পর্কে সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাই বিবর্তনকে শুধুমাত্র একটি অনুমান হিসেবে দেখা সম্পূর্ণ ভুল। 

২. “মানুষ বানর থেকে এসেছে” 

এটি বিবর্তন সম্পর্কে সবচেয়ে প্রচলিত ভুল ধারণাগুলোর একটি। অনেকে মনে করেন, বিবর্তন তত্ত্ব বলে যে মানুষ সরাসরি বানর থেকে এসেছে, যা একেবারেই সঠিক নয়। 

বিবর্তন আসলে বলে যে মানুষ এবং বর্তমান বানরদের (Chimpanzees, Gorillas) একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ ছিল, যা প্রায় ৬-৭ মিলিয়ন বছর আগে বাস করত। এই পূর্বপুরুষ থেকে এক শাখা আধুনিক মানুষের দিকে (Homo sapiens) বিবর্তিত হয়েছে, আর অন্য শাখা আজকের শিম্পাঞ্জি ও অন্যান্য এপদের দিকে গেছে। 

এটি বোঝার জন্য পারিবারিক গাছের উদাহরণ নেওয়া যেতে পারে। যেমন, আপনি এবং আপনার চাচাতো ভাইয়ের পূর্বপুরুষ এক, কিন্তু আপনারা একে অপরের কাছ থেকে আসেননি। তেমনি, মানুষ এবং শিম্পাঞ্জির মধ্যে একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ ছিল, যা সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়ে বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়েছে। তাই “মানুষ বানর থেকে এসেছে” ধারণাটি ভুল। 

৩. “বিবর্তন এলোমেলো (Random) প্রক্রিয়া” 

এটি একটি ভুল ধারণা, কারণ বিবর্তনের কিছু অংশ এলোমেলো হতে পারে, কিন্তু পুরো প্রক্রিয়াটি নয়। বিবর্তনের দুটি প্রধান অংশ আছে—উচ্চরণ (Mutation) এবং প্রাকৃতিক নির্বাচন (Natural Selection)। 

  • উচ্চরণ (Mutation): যখন কোনো জীবের ডিএনএ-তে আকস্মিক পরিবর্তন ঘটে, তখন তাকে উচ্চরণ বলা হয়। এটি এলোমেলোভাবে ঘটতে পারে এবং এর ফলে নতুন বৈশিষ্ট্যের সৃষ্টি হয়। 
  • প্রাকৃতিক নির্বাচন (Natural Selection): এই প্রক্রিয়া এলোমেলো নয়। প্রকৃতিতে যে বৈশিষ্ট্যগুলো জীবের বেঁচে থাকা ও প্রজননে সহায়ক হয়, সেগুলো টিকে থাকে, আর অপ্রয়োজনীয় বা ক্ষতিকর বৈশিষ্ট্যগুলো ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এই নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ এলোমেলো নয় বরং এটি পরিবেশের উপর নির্ভর করে ঘটে। 

অতএব, উচ্চরণ এলোমেলো হতে পারে, কিন্তু বিবর্তন নয়। বিবর্তন পরিচালিত হয় প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে। 

৪. “আমরা কখনো বিবর্তন ঘটতে দেখিনি” 

এই দাবি সম্পূর্ণ ভুল। বিজ্ঞানীরা সরাসরি বিবর্তন ঘটতে দেখেছেন এবং এটি নথিভুক্তও করেছেন। বিবর্তন একটি দীর্ঘ সময়ের প্রক্রিয়া, তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি দ্রুতও ঘটতে পারে। 

পর্যবেক্ষিত বিবর্তনের কিছু উদাহরণ: 

  • ব্যাকটেরিয়ার অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতা: 
  • কিছু ব্যাকটেরিয়া দ্রুত প্রতিরোধী হয়ে ওঠে, যা জীবন্ত বিবর্তনের প্রমাণ। অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করলে দুর্বল ব্যাকটেরিয়া মরে যায়, কিন্তু যারা প্রতিরোধী তারা বেঁচে থাকে এবং বৃদ্ধি পায়। এটি বিবর্তনের একটি স্পষ্ট উদাহরণ। 
  • গ্যালাপাগোস দ্বীপের ফিঞ্চ পাখি: 
  • বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন দেখেছিলেন যে দ্বীপের বিভিন্ন ফিঞ্চ পাখির ঠোঁটের আকৃতি আলাদা, কারণ তারা আলাদা ধরনের খাবারের সাথে মানিয়ে নিয়েছিল। 
  • কৃত্রিম নির্বাচন (Artificial Selection): 
  • আমরা কৃত্রিমভাবে উদ্ভিদ ও প্রাণীদের পরিবর্তন ঘটাতে পারি (যেমন, কুকুরের বিভিন্ন জাত, নতুন শস্যের উদ্ভাবন)। এটি প্রমাণ করে যে বিবর্তন একটি বাস্তব প্রক্রিয়া। 

অর্থাৎ, বিবর্তন শুধুমাত্র অতীতে ঘটেনি, এটি আজও ঘটছে এবং আমরা তা সরাসরি দেখতে পারি। 

৫. “বিবর্তন জটিল জীব গঠনের ব্যাখ্যা দিতে পারে না” 

অনেকে মনে করেন যে এত জটিল জীব বিবর্তনের মাধ্যমে আসতে পারে না, বিশেষ করে চোখের মতো জটিল অঙ্গ কীভাবে ধাপে ধাপে গঠিত হতে পারে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, চোখের বিবর্তন ধাপে ধাপে ঘটেছে। 

চোখের বিবর্তনের ধাপ: 

  1. প্রথমে, কিছু জীবের আলো সংবেদনশীল কোষ তৈরি হয়। 
  1. ধাপে ধাপে, এই কোষগুলোর সংখ্যা বাড়ে এবং গর্তের মতো কাঠামো তৈরি হয়, যা দিকনির্দেশনা বুঝতে সাহায্য করে। 
  1. পরে, স্বচ্ছ স্তর (লেন্স) তৈরি হয়, যা আলোকে ফোকাস করতে পারে। 

অর্থাৎ, চোখের মতো জটিল অঙ্গও ধাপে ধাপে গঠিত হতে পারে, যা বিবর্তনের সাপেক্ষে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। 

৬. “বিবর্তন নতুন প্রজাতি তৈরি করতে পারে না” 

অনেকেই দাবি করেন, বিবর্তন নতুন প্রজাতি সৃষ্টি করতে পারে না, কিন্তু আধুনিক গবেষণা থেকে জানা গেছে যে বিবর্তনের ফলে নতুন প্রজাতির সৃষ্টি সম্ভব। 

নতুন প্রজাতির উদাহরণ: 

  • কিছু মাছ ও পোকা এক প্রজন্মের মধ্যেই নতুন বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে। 
  • পরীক্ষাগারে বিজ্ঞানীরা ব্যাকটেরিয়ার নতুন প্রজাতি তৈরি করেছেন। 
  • প্রাকৃতিক পরিবেশে কিছু উদ্ভিদ ও পশু নতুন প্রজাতি তৈরি করেছে। 

অর্থাৎ, বিবর্তন নতুন প্রজাতির সৃষ্টি করতে পারে এবং এটি পর্যবেক্ষণযোগ্য। 

উপসংহার 

বিবর্তন একটি সুপ্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, যা অসংখ্য প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত। কিন্তু ভুল ধারণা, শিক্ষার অভাব, এবং প্রচলিত মিথ্যার কারণে অনেকেই এটি ভুলভাবে বোঝেন। বিজ্ঞান সম্পর্কে জানার মাধ্যমে আমরা এই ভুল ধারণাগুলো দূর করতে পারি এবং প্রকৃত সত্যকে বুঝতে পারি। 

Share: Facebook Twitter Linkedin
Leave a Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *