বাংলাদেশ একটি বহুধার্মিক, বহু-সাংস্কৃতিক রাষ্ট্র। এই দেশের জন্ম হয়েছে একটি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতিতে। অথচ ১৯৮৮ সালে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনের মাধ্যমে “ইসলাম” রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংযুক্ত করা হয়, যা সংবিধানের মূল দর্শনের সাথে সাংঘর্ষিক। এই ব্লগে যুক্তির ভিত্তিতে দেখানো হবে কেন রাষ্ট্রধর্মের ধারণাটি বাংলাদেশের জন্য অপ্রাসঙ্গিক, বৈষম্যমূলক ও সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী।
১. সংবিধানের মূলনীতি ও রাষ্ট্রধর্মের সাংঘর্ষিকতা
বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্র—এই চারটি মৌলনীতি প্রতিষ্ঠা করেছিল। রাষ্ট্রধর্মের সংযোজন সরাসরি “ধর্মনিরপেক্ষতা” নীতির পরিপন্থী।
উদাহরণস্বরূপ:
- সংবিধানের ২(ক) ধারায় বলা হয়, “রাষ্ট্রের ধর্ম ইসলাম হবে।”
- কিন্তু ১২ অনুচ্ছেদে ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যা বলেছে: “ধর্মীয় ভাবাবেগের ভিত্তিতে রাজনীতি হইবে না এবং কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি রাষ্ট্র পক্ষপাত দেখাইবে না।”
এই দুই ধারার মধ্যে মৌলিক বিরোধ স্পষ্ট। একজন নাগরিক কিভাবে একসাথে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম—দুটিকে সমর্থন করবেন?
📚 সোর্স:
২. বৈষম্যের সুযোগ সৃষ্টি করে
রাষ্ট্রধর্ম থাকলে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় স্বাভাবিকভাবেই মনে করে তারা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক।
পর্যবেক্ষণমূলক যুক্তি:
যেখানে সংবিধান ধর্মীয় সমতা ও অভিন্ন নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি দেয়, সেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি ধর্মকে বিশেষ মর্যাদা দিলে অন্যান্য ধর্মের মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়।
উদাহরণ:
- হিন্দু বা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নাগরিকরা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে কতটা অন্তর্ভুক্ত?
- ক’টি ধর্মীয় উৎসব রাষ্ট্রীয়ভাবে ছুটি পায়?
📚 সোর্স:
- Dr. Mizanur Rahman, “Constitutional Law of Bangladesh”, University of Dhaka Press
- Minority Rights Group International Report, 2021: “Religious Minorities in South Asia”
৩. রাজনৈতিক ব্যবহারের উপাদান হয়ে ওঠে
রাষ্ট্রধর্মের ধারণাটি বাস্তবে কোনো নীতিগত প্রয়োগযোগ্য কাঠামো নয়, বরং এটি রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারযোগ্য একটি হাতিয়ার।
বিশ্লেষণ:
১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণার পেছনে সামরিক শাসকের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল।
পূর্ববর্তী ঐতিহাসিক বাস্তবতা:
- বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রণীত সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ছিল না
- ১৯৮৮ সালে এর সংযোজন আসে এরশাদের সময়ে, গণচাপের মুখে নিজের অবস্থান রক্ষা করতে
📚 সোর্স:
- Rounaq Jahan, Bangladesh: Promise and Performance, Zed Books, London
- The Daily Star Editorial (March 2016): “Is State Religion Islam Compatible with Secularism?”
৪. সাংবিধানিক দ্বৈততা ও আইনগত অনিশ্চয়তা
রাষ্ট্রধর্ম থাকার ফলে সংবিধানে একধরনের আইনগত দ্বৈততা ও অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে, যা বিচারিক প্রক্রিয়ায় জটিলতা সৃষ্টি করে।
সংবিধানিক আইনি দ্বৈততার উদাহরণ:
- আপনি যদি একদিকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম মেনে নেন, তাহলে ইসলামবিরোধী বলে বিবেচিত মত বা আচরণ কি শাস্তিযোগ্য হবে?
- আবার ধর্মনিরপেক্ষতার দাবি থাকলে, কিভাবে সব ধর্মের সমান অধিকার নিশ্চিত হবে?
এই দ্বৈততা আইনের শাসনের পরিপন্থী।
📚 সোর্স:
- Justice Habibur Rahman, “Constitutional Development in Bangladesh”, University Press Limited
- BLAST vs Bangladesh Case, 2011 – ধর্মনিরপেক্ষতা পুনঃস্থাপনের রায়
৫. আধুনিক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রধর্ম অনুপযুক্ত
বিশ্বের বহু উন্নত ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধর্ম ও রাষ্ট্র পৃথক।
তুলনামূলক বিশ্লেষণ:
- ভারত: সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষ, রাষ্ট্রধর্ম নেই
- যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি: ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্র কাঠামোর অংশ
- ইন্দোনেশিয়া: সবচেয়ে বড় মুসলিম জনসংখ্যা থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নয়
📚 সোর্স:
- Pew Research Center, “Constitutional References to Religion”, 2017
- Comparative Constitutions Project: https://comparativeconstitutionsproject.org
স্লোগান হিসেবে বলা যায়:
📢 “ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার” — এই নীতিতেই মুক্তি।