বাংলাদেশের রাজনীতি এক জটিল ও বহুমাত্রিক বাস্তবতার প্রতিফলন, যার মাঝে প্রতিবারই ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছে। দল বদলালেও শাসনপদ্ধতির ধরন ও আচরণে তেমন কোনো মৌলিক পরিবর্তন দেখা যায় না। ক্ষমতা পাওয়ার পর প্রায় সব রাজনৈতিক দলই নিজেকে রাষ্ট্রের প্রতিভূ হিসেবে কল্পনা করে, আর বাকিদের দেশবিরোধী কিংবা ষড়যন্ত্রকারী বলে আখ্যায়িত করে—এ যেন এক ধারাবাহিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকেই এই প্রবণতা লক্ষ করা যায়। ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়ন এবং আওয়ামী লীগের একচেটিয়া আধিপত্য দিয়ে যে শাসনযাত্রা শুরু হয়েছিল, তাতে দ্রুতই দলীয়করণ, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন, এবং বিরুদ্ধ মতকে দোষারোপের প্রবণতা গড়ে ওঠে। ১৯৭৫ সালের একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থার মাধ্যমে ভিন্নমত দমনের যে সংস্কৃতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছিল, তা সামরিক শাসনের মধ্য দিয়ে আরও শক্তিশালী হয়। এরপর ক্ষমতায় আসা সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও এরশাদের সময়েও প্রতিপক্ষ দল ও মতকে রাষ্ট্রদ্রোহী তকমা দিয়ে দমন করা হয়, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করা হয়, এবং প্রশাসনকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা হয়।
গণতন্ত্র ফিরে এলেও, নব্বই পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পালাক্রমে ক্ষমতায় এসে কার্যত একই ধরনের স্বেচ্ছাচারী প্রবণতা দেখিয়েছে। বিএনপি যখন ২০০১-২০০৬ মেয়াদে ক্ষমতায় ছিল, তখন বিরোধীদলীয় নেতাদের ওপর হামলা, প্রশাসনে দলীয় নিয়োগ, বিরোধী কণ্ঠ রোধ, এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে রাজনৈতিক সংকট দেশকে এক ভয়ানক দুঃসময় উপহার দেয়। আবার আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার কথা বললেও, বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে বাধা, গুম-খুনের অভিযোগ, এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণের ঘটনা সাধারণ মানুষের মধ্যে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
ক্ষমতায় থাকা দলগুলো প্রায়শই রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে থাকে। বিচার বিভাগ, পুলিশ প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দলীয়করণে জর্জরিত। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের, গ্রেপ্তার, হুমকি, এবং নির্যাতন যেন রুটিন কর্মকাণ্ড হয়ে গেছে। কোনো রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় গিয়ে গণতান্ত্রিক চর্চার অনুশীলনে আগ্রহ দেখায় না, বরং ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে নানা কৌশল অবলম্বন করে। সংবিধান সংশোধন থেকে শুরু করে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ, এমনকি নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়েও বারবার প্রশ্ন উঠেছে।
অন্যদিকে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকেও চাপে রাখা হয় নানা কৌশলে—আইন করে, ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে, অথবা সরাসরি হস্তক্ষেপ করে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কিংবা প্রচলিত দণ্ডবিধির নানা ধারাকে ব্যবহার করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করলেই হয়রানি, এমনকি গ্রেপ্তারের ঘটনা ক্রমবর্ধমান।
এই রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতা শুধু শাসনব্যবস্থাকেই দুর্বল করে না, জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক বিমুখতাও তৈরি করে। তরুণ সমাজ রাজনীতির প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে, কারণ তারা দেখছে—নতুন কোনো দৃষ্টিভঙ্গি বা ইতিবাচক পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই, শুধু ক্ষমতা দখলের লড়াই চলছে।
তবে এ অবস্থা চিরস্থায়ী নয়। ইতিহাস বলে, জনগণের চাপে, সময়ের দাবি মেনে, অনেক স্বৈরাচারী ব্যবস্থাও বদলাতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষও অতীতে আন্দোলনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছে। ভবিষ্যতের সম্ভাবনা নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর আত্মসমালোচনার ক্ষমতা, জনগণের সচেতন অংশগ্রহণ, এবং একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন নাগরিক সমাজের ওপর। এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে হলে দরকার একটি অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন, জবাবদিহিতামূলক ও সহনশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতি—যেখানে ক্ষমতা মানেই কর্তৃত্ব নয়, বরং জনগণের সেবক হিসেবে দায়িত্ব পালনের প্রতিশ্রুতি।