ভালোবাসা মানবজীবনের এক পরম অনুভব—নির্বিশেষে লিঙ্গ, জাতি বা ধর্ম। কিন্তু যখন সেই ভালোবাসা হয় সমলিঙ্গের দুইজন মানুষের মধ্যে, তখন তা বাংলাদেশের মতো রক্ষণশীল সমাজে কেবল প্রশ্নবিদ্ধই নয়, বরং অনেকক্ষেত্রে নিন্দিত ও দণ্ডনীয় হয়ে দাঁড়ায়।
সমলিঙ্গ প্রেম—একটি বাস্তবতা, কোনো ফ্যান্টাসি নয়
সমলিঙ্গ প্রেম বা সম্পর্ক কেবল পশ্চিমা দেশের আমদানি নয়। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, উপমহাদেশেও সমলিঙ্গ সম্পর্কের অস্তিত্ব প্রাচীনকাল থেকেই রয়েছে—কবিতা, শিল্পকর্ম ও লোককাহিনিতে তার ছাপ স্পষ্ট। বর্তমানেও বাংলাদেশের অনেক মানুষ সমলিঙ্গ আকর্ষণ অনুভব করেন, কিন্তু সামাজিক চাপ ও ভয়ের কারণে তারা নিজেদের আবেগ লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হন।
বাংলাদেশের আইনি ও সামাজিক প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশে এখনো সেকশন ৩৭৭ (ভারতের মতো) অপরিবর্তিত রয়েছে, যা সমলিঙ্গ যৌন সম্পর্ককে ‘অপ্রাকৃতিক’ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। যদিও বাস্তবিক অর্থে এ ধারা খুব কম প্রয়োগ হয়, তবে এর অস্তিত্বই LGBTQ+ সম্প্রদায়ের ওপর এক ধরনের রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের ছায়া ফেলে রেখেছে।
সামাজিকভাবে, সমলিঙ্গ সম্পর্ককে “অসামাজিক”, “অধর্মীয়”, কিংবা “পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব” বলে প্রত্যাখ্যান করা হয়। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া, বন্ধুত্ব হারানো, এমনকি সহিংসতার শিকার হওয়াও এখানে বিরল নয়।
মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব
সমস্যার মূলেই রয়েছে শিক্ষা ও সহানুভূতির অভাব। অধিকাংশ মানুষ জানেন না যে সমলিঙ্গ প্রেম একটি প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, কোনো ‘বিকৃতি’ নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বহু আগেই সমলিঙ্গ আকর্ষণকে মানসিক ব্যাধির তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে। কিন্তু আমাদের পাঠ্যপুস্তক, গণমাধ্যম বা ধর্মীয় আলোচনায় এই বিষয়ে কোনো ইতিবাচক বা তথ্যভিত্তিক বার্তা দেওয়া হয় না।
আশার আলো—নতুন প্রজন্ম ও সচেতনতা
তবে আশার কথা হলো, বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের অনেকেই এখন এই বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন করছে, অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আলোচনা করছে, এবং ধীরে ধীরে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের চিন্তা মাথায় আনছে। ফেসবুক, ইউটিউব বা স্বাধীন ব্লগগুলোতে LGBTQ+ বিষয়ক কনটেন্টের বিস্তার ঘটেছে, যা একধরনের সামাজিক বিপ্লবের সূচনা করেছে।
ভবিষ্যতের পথ
সমলিঙ্গ ভালোবাসার প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হলে আমাদের প্রয়োজন:
- মানবিকতা ভিত্তিক শিক্ষা — যা বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দিতে শেখায়।
- আইনি সংস্কার — সেকশন ৩৭৭-এর বাতিল ও নিরাপত্তা প্রদান।
- মাধ্যমে ইতিবাচক উপস্থাপন — সিনেমা, নাটক ও সাহিত্য যেন বৈচিত্র্যের প্রতিনিধিত্ব করে।
- ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয় — সহনশীলতা ও ভালোবাসার মর্মবাণীকে সামনে আনা।
ভালোবাসা কোনো পাপ নয়। সমলিঙ্গ প্রেম কোনো অপরাধ নয়। আমরা যদি একটি সহানুভূতিশীল, মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন করতে চাই, তাহলে আমাদের অবশ্যই ভালোবাসার রঙগুলোকে স্বীকৃতি দিতে শিখতে হবে—যত বৈচিত্র্যপূর্ণই হোক না কেন।