বাংলাদেশ একটি ধর্মপ্রাণ দেশ। এখানকার মানুষের জীবনে ধর্মের প্রভাব বিশাল ও গভীর। ইসলাম, হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ও খ্রিষ্টধর্ম — প্রতিটি ধর্মের অনুসারীরাই তাদের বিশ্বাসকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। কিন্তু যখন এই বিশ্বাসে যুক্তির জায়গা ম্লান হয়, এবং ধর্মকে অন্ধভাবে অনুসরণ করা হয়, তখন তা কেবল ব্যক্তির নয়, গোটা সমাজের জন্যই একটি বড় বিপদ হয়ে দাঁড়ায়।
📌 অন্ধ অনুসরণের সংজ্ঞা
অন্ধভাবে ধর্ম অনুসরণ মানে হল — প্রশ্ন না করে, ভাবনা না করে, বিবেক-বুদ্ধি বন্ধ রেখে ধর্মীয় নিয়ম বা ব্যক্তি বিশেষের ব্যাখ্যাকে মানা। এই ধরণের আচরণে মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা ও মানবিকতা হারিয়ে যায়। তখন ধর্ম বিশ্বাসের উৎস না হয়ে হয়ে দাঁড়ায় ভয়, বিদ্বেষ আর অন্ধত্বের এক মোড়ক।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর বাস্তব রূপ
১. শিক্ষা ও বিজ্ঞানবিমুখতা
বাংলাদেশের কিছু এলাকায় এখনো বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা হুমকির মুখে পড়ে, যখন ধর্মীয় অনুভূতির নামে পাঠ্যবইয়ের বিরোধিতা করা হয়। জ্যোতির্বিজ্ঞান, বিবর্তনবাদ বা যৌন স্বাস্থ্য শিক্ষা নিয়ে সচেতনতা তৈরি করার বদলে, এগুলোকে ‘ধর্মবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা চলে।
২. নারীর অধিকার ও স্বাধীনতা হরণ
ধর্মের অপব্যাখ্যা করে নারীদের ঘরে আটকে রাখা, বাল্যবিবাহকে বৈধতা দেওয়া বা নারীর শিক্ষা ও কর্মসংস্থানকে ‘অনুচিত’ বলা হয় — যা দেশের অগ্রগতির জন্য মারাত্মক বাধা। অথচ প্রকৃত ধর্ম নারীর সম্মান ও সমানাধিকারের কথাই বলে।
৩. সহিংসতা ও বিদ্বেষ ছড়ানো
ধর্মের নামে গুজব ছড়িয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতি আঘাতের অভিযোগ তুলে কাউকে গণপিটুনি দেওয়া — এগুলো বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘটছে। এগুলোর মূলে থাকে ধর্মীয় উস্কানি ও অন্ধ অনুসরণ।
৪. মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদে প্রলুব্ধতা
অশিক্ষা ও ধর্মের একতরফা ব্যাখ্যা সহজেই তরুণদের মৌলবাদের পথে ঠেলে দেয়। তারা ধর্মের নামেই নৃশংসতা করতে উদ্বুদ্ধ হয়, যেমনটা ২০১৬ সালের গুলশান হামলায় আমরা দেখেছি। এখানে ধর্ম নয়, ধর্মের নামে প্রচারিত বিকৃত চিন্তা দায়ী।
অন্ধতা নয়, আলো চাই
ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা উচিত — সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই শ্রদ্ধা যেন চিন্তাশক্তিকে বন্ধ না করে। প্রশ্ন করা, বুঝে নেওয়া, আলোচনার জায়গা থাকা চাই। একমাত্র যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও সুশিক্ষা দিয়েই অন্ধ অনুসরণের এই অন্ধকার থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
✅ করণীয়:
- ধর্মীয় শিক্ষার আধুনিকায়ন ও ব্যাখ্যায় যুক্তিবাদী মনোভাব প্রতিষ্ঠা করা
- সব ধর্মের প্রতি সহনশীলতা গড়ে তোলা
- সামাজিক মাধ্যমে ধর্মভিত্তিক গুজব মোকাবেলায় সচেতনতা বৃদ্ধি
- শিশু-কিশোরদের নৈতিকতা ও বিজ্ঞানমনস্কতার সমন্বয়ে শিক্ষা দেওয়া
বাংলাদেশ যদি উন্নত, মানবিক ও সচেতন একটি রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠতে চায়, তবে অন্ধভাবে ধর্ম অনুসরণ নয়, যুক্তির আলোয় ধর্মকে দেখার সময় এসেছে। ধর্ম হোক শান্তির, সহানুভূতির এবং জ্ঞানের পথ — অন্ধত্বের নয়।