ধর্মীয় উগ্রবাদ বর্তমান বিশ্বে এক জটিল ও বহুমাত্রিক সংকটের নাম, যা কেবল একটি রাষ্ট্র বা একটি জাতিগোষ্ঠীর সীমায় আবদ্ধ নয়। এটি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যেমন ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে, তেমনি বাংলাদেশেও এর উপস্থিতি ক্রমশ উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। ধর্মীয় বিশ্বাস মূলত মানুষের আত্মিক উন্নয়ন, নৈতিকতা চর্চা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। কিন্তু যখন সেই ধর্মবিশ্বাসকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়, এবং ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়, তখন তা হয়ে ওঠে উগ্রবাদ—যা ধর্মের মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।
বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদের উত্থান একটি জটিল সামাজিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ফল। দেশের স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে কিছু গোষ্ঠী ধর্মের নামে সহিংসতা ও বিভেদ ছড়ানোর চেষ্টা করেছে। কখনো রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে, কখনো বিদেশি চরমপন্থী আদর্শের প্রভাবে, আবার কখনো সামাজিক অবিচার ও বঞ্চনার সুযোগ নিয়ে উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ব্লগার হত্যা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের নামে সহিংস প্রতিক্রিয়া—এসব ঘটনার পেছনে ছিল এক ধরনের সংগঠিত ও চরমপন্থী চিন্তা, যেটি সমাজে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে।
বর্হিবিশ্বেও ধর্মীয় উগ্রবাদ এক বৈশ্বিক আতঙ্কের রূপ নিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে ইসলামী উগ্রবাদ যেমন ভয়ংকর রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে, তেমনি ইউরোপ ও আমেরিকায় খ্রিস্টীয় বা বৌদ্ধ ধর্মের চরমপন্থাও রাজনৈতিক ও সামাজিক উত্তেজনার কারণ হয়েছে। ‘আল-কায়েদা’, ‘আইএস’, ‘বোকো হারাম’-এর মতো সংগঠনগুলো ধর্মের নামে বিশ্বব্যাপী সহিংসতা ছড়িয়ে দিয়েছে, যার প্রভাবে মুসলিমরা আজ বিশ্বজুড়ে সন্দেহ ও ঘৃণার মুখোমুখি। অন্যদিকে, ইউরোপে উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলোর হাতে মসজিদে হামলা, মুসলিম বিদ্বেষমূলক প্রচারণা বা ধর্মীয় পোশাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা, একইভাবে এক ধরণের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এবং উগ্রতারই বহিঃপ্রকাশ।
উগ্রবাদকে জিইয়ে রাখে অজ্ঞতা, হতাশা, দারিদ্র্য, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং রাজনৈতিক অপব্যবহার। এই সব উপাদান যখন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর চিন্তা ও চেতনায় জায়গা করে নেয়, তখন ধর্মকে ব্যবহার করে তারা হয়ে ওঠে সহিংস, অসহিষ্ণু এবং মানবিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। এটা বোঝা জরুরি যে, উগ্রবাদ কোনো ধর্মেরই প্রতিনিধিত্ব করে না; বরং এটি কিছু লোকের বিকৃত মানসিকতারই প্রকাশ, যারা ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য পূরণে সচেষ্ট।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আশার কথা হলো—ধর্মীয় উগ্রবাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ, বুদ্ধিজীবী মহল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাঝে সচেতনতা বেড়েছে। তরুণ প্রজন্ম প্রযুক্তি ও শিক্ষার মাধ্যমে বিকল্প চিন্তা ও সহনশীলতার চর্চা করছে। একইসাথে প্রয়োজন ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাখ্যার আধুনিকায়ন, যাতে মানুষ বুঝতে পারে—ধর্ম আসলে শান্তির, সহমর্মিতার, এবং মানবিকতার শিক্ষা দেয়। আন্তর্জাতিকভাবে, রাষ্ট্রগুলোর উচিত নিজেদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে ধর্মীয় সহিংসতা ও উগ্রবাদ দমন করার লক্ষ্যে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা।
উগ্রতা কখনো কোনো সমস্যার সমাধান নয়; বরং তা নতুন সংকটের জন্ম দেয়। তাই প্রয়োজন সঠিক ধর্মীয় শিক্ষা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, এবং বহুত্ববাদী চিন্তাকে উৎসাহিত করা। তাহলেই ধর্মীয় উগ্রবাদের ধ্বংসাত্মক পথ থেকে বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব ফিরে আসতে পারবে মানবতার পথে।