বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাস বহু চড়াই-উতরাইয়ে ভরা। এক সময় যে সংগঠন ছিল দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রভাগে, আজ তারই একটি শাখা — বাংলাদেশ ছাত্রলীগ — নানা সময় আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের কারণে। বিশেষ করে সাধারণ মানুষের উপর ছাত্রলীগের নির্যাতন এখন আর বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, বরং ক্রমবর্ধমান এক সমাজ-রাজনৈতিক সংকটের নাম হয়ে উঠেছে।
ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, এমনকি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধেও এই সংগঠনের গৌরবজ্জ্বল ভূমিকা ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সংগঠনটি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র শাখা হয়ে উঠেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে রাজনীতির দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে।
নির্যাতনের বহুমাত্রিক রূপ
সাধারণ মানুষের উপর ছাত্রলীগের নির্যাতনের ধরন এখন অনেকটাই রূপান্তরিত হয়েছে। রাজনৈতিক বিরোধী দল বা মতালম্বীদের উপর হামলা, সাংবাদিকদের উপর চড়াও হওয়া, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধর, এমনকি সামাজিক মাধ্যমে মতপ্রকাশ করায় তরুণদের নিপীড়নের শিকার হওয়া — এসব ঘটনার মধ্যে ছাত্রলীগের নাম ঘুরেফিরে আসে।
বিশেষ কিছু উদাহরণ:
- বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সহিংসতা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রুয়েট, জাহাঙ্গীরনগর — প্রায় সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। “র্যাগিং”, “শোডাউন”, কিংবা “পলিটিক্যাল লাইন না মানা” — এসব কারণেই শিক্ষার্থীদের উপর অমানবিক শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের ঘটনা অহরহ।
- বিক্ষোভ দমন: নিরাপদ সড়ক আন্দোলন (২০১৮) এবং কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময়ও দেখা গেছে, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সরাসরি সাধারণ ছাত্রদের ওপর হামলা চালিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় এসব সহিংসতা ঘটেছে।
- মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ: ফেসবুকে সরকারবিরোধী বা ছাত্রলীগবিরোধী মন্তব্য করায় দেশের নানা প্রান্তে তরুণ-তরুণীদের উপর হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও ছাত্রলীগের তথ্যের ভিত্তিতে ‘ক্র্যাকডাউন’ চালিয়েছে।
কারণ ও পেছনের রাজনীতি
এই সহিংসতার পেছনে কিছু নির্দিষ্ট কারণ কাজ করে। প্রথমত, ছাত্রলীগ এখন আর আদর্শিক সংগঠন নয়; এটি ক্ষমতা, প্রভাব ও অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে অনেক নেতাকর্মীর কাছে। দ্বিতীয়ত, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এই নির্যাতনকে আরও উৎসাহিত করে। হামলা-মামলা করেও অনেক সময় দেখা যায়, অভিযুক্তদের দলে ‘ভাল ছেলে’ আখ্যা দিয়ে রক্ষা করা হয়।
সমাজে প্রভাব
ছাত্রলীগের এই ধরনের কর্মকাণ্ড শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে ভীতি সৃষ্টি করছে না, পুরো সমাজেই এক ধরনের আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। শিক্ষাঙ্গনের মত স্বাধীন চিন্তা-ভাবনার জায়গাগুলোতে ভয় ও দমন-পীড়নের সংস্কৃতি ছাত্ররাজনীতির জন্যই শুধু নয়, জাতির ভবিষ্যতের জন্যও হুমকিস্বরূপ।
ছাত্রলীগ একসময় দেশের গর্ব ছিল — স্বাধীনতার যাত্রাপথে এক অবিচ্ছেদ্য সংগঠন। আজ যদি সেই সংগঠনের নাম শুনলেই ভয়, আতঙ্ক, কিংবা নির্যাতনের স্মৃতি মনে পড়ে — তাহলে এটা কেবল ছাত্রলীগের ব্যর্থতা নয়, গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থারই ব্যর্থতা। রাজনীতির ময়দান থেকে সন্ত্রাস, দমন, ও দলান্ধতা দূর না হলে এই দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি অন্ধকারময় সমাজে বড় হবে। এখন সময় এসেছে আত্মসমালোচনা ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার — কারণ একটি গণতান্ত্রিক সমাজে ছাত্র রাজনীতি মানেই হওয়া উচিত সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর, নিপীড়নের নয়।