বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও সময়ের সাথে সাথে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এবং উগ্রবাদী কর্মকাণ্ড উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। বিশেষ করে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব, দুর্গাপূজা, বারবার সহিংসতা এবং হামলার লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। অনেকক্ষেত্রে এই সহিংসতার পেছনে ছিল কিছু ইসলামি সংগঠন, যারা রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় উদ্দেশ্যে এ ধরনের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে থাকে।
ইতিহাসের পেছনে ফেরা: দুর্গাপূজায় সহিংসতার নজির
বাংলাদেশে দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নিচে তুলে ধরা হলো:
🔹 ২০১২ – রামু, কক্সবাজার:
একটি বৌদ্ধ তরুণের বিরুদ্ধে কুরআন অবমাননার অভিযোগ তুলে একটি ভুয়া ফেসবুক পোস্ট ছড়িয়ে দিয়ে রামুতে বৌদ্ধ বিহার, ঘরবাড়ি ও দোকানে ভয়াবহ হামলা চালানো হয়। যদিও দুর্গাপূজার সময় ছিল না, তবে এ ঘটনায় প্রমাণিত হয়—ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে সহিংসতা সংগঠিত করা কতটা সহজ।
🔹 ২০২০ – কুমিল্লা দুর্গাপূজার সহিংসতা:
২০২১ সালে কুমিল্লার একটি পূজামণ্ডপে কুরআন শরীফ রাখার অভিযোগ তুলে উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়। এরপর দেশের ২০টিরও বেশি জেলায় মন্দির, প্রতিমা, পূজামণ্ডপ ও হিন্দুদের ঘরবাড়িতে ব্যাপক হামলা চালানো হয়।
উল্লেখযোগ্য ভাঙচুর ও সহিংসতা হয়:
- নোয়াখালী, চাঁদপুর, ফেনী, চট্টগ্রাম ও রংপুরে।
- নিহত হয় অন্তত ৭ জন।
- শতাধিক মন্দির ও পূজামণ্ডপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ইসলামী সংগঠনগুলোর ভূমিকা
বাংলাদেশে ধর্মীয় সংগঠন অনেক ধরনের কাজ করে থাকলেও কিছু উগ্র মতাদর্শ-সম্পন্ন ইসলামি সংগঠন—যেমন হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন, তাওহিদি জনতা ইত্যাদি—এ ধরনের ঘটনায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার অভিযোগ পেয়েছে।
▶ হেফাজতে ইসলাম:
এই সংগঠনটি বারবার ধর্মীয় ইস্যুতে রাস্তায় নেমে সহিংসতা চালানোর অভিযোগে আলোচিত। যদিও সংগঠনটি প্রকাশ্যে সহিংসতা উস্কে দেয়ার কথা অস্বীকার করে, বাস্তবে তাদের সমর্থকদের অনেকেই ধর্মীয় গুজব ছড়িয়ে সহিংসতায় অংশ নেয়।
▶ সোশ্যাল মিডিয়া ও গুজব:
অসত্য তথ্য ও ফেসবুক পোস্টের স্ক্রিনশট ছড়িয়ে অনেক সময় পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করা হয়। এর পেছনে ইসলামি উগ্র গোষ্ঠী সমর্থিত অ্যাকাউন্ট বা পেইজের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া ও আইনের প্রয়োগ
প্রতিটি ঘটনার পর প্রশাসন কড়া প্রতিক্রিয়া দেখালেও অনেক সময় অপরাধীদের শাস্তি হয় না কিংবা ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যায়। ফলে, এটি একটি “সিস্টেমিক ইমপিউনিটি” তৈরি করে, যার ফলে ভবিষ্যতে আবার সহিংসতার পুনরাবৃত্তি ঘটে।
সরকার যেসব পদক্ষেপ নেয়:
- বিজিবি মোতায়েন ও মোবাইল কোর্ট চালু
- ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ
- কিছু ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার
কিন্তু…
- বেশিরভাগ ঘটনায় মূল পরিকল্পনাকারীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।
- সংখ্যালঘুদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ে।
বিশ্লেষণ: কেন বারবার পূজায় সহিংসতা হয়?
- ধর্মীয় গুজব ছড়ানো সহজ: সাধারণ জনগণ ধর্মীয় ইস্যুতে খুব সংবেদনশীল, যা উগ্র গোষ্ঠীগুলোর জন্য সুযোগ তৈরি করে।
- রাজনৈতিক ফায়দা তোলা: কখনো কখনো রাজনীতির অংশ হিসেবে এই সহিংসতা ইন্ধন পায়।
- সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরদারির ঘাটতি: ভুয়া পোস্ট দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং গণমানুষের ক্ষোভ তৈরি করে।
- দায়মুক্তি সংস্কৃতি: আগের ঘটনার বিচার না হওয়ায় ভবিষ্যতে অনুরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে।
বাংলাদেশে দুর্গাপূজায় সহিংসতা কেবল একটি ধর্মীয় সমস্যা নয়, এটি এক ধরনের রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা এবং সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত উগ্রবাদী মনোভাবের প্রতিফলন। ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষায় শুধু প্রশাসনিক তৎপরতা নয়, প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং আন্তঃধর্মীয় সংলাপ। ইসলামি সংগঠনগুলোকেও আত্মসমালোচনার মাধ্যমে সহনশীলতা ও সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করতে হবে—না হলে, উৎসবের সময় নিরাপত্তা নয়, আতঙ্কই নিয়ম হয়ে দাঁড়াবে।