বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও, দেশটির ইতিহাস, রাজনীতি এবং সামাজিক কাঠামোর সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই জটিল ও সংবেদনশীল। ধর্মীয় অনুভূতিকে কেন্দ্র করে সময় সময় দেশে যে অরাজকতা সৃষ্টি হয়, তার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও প্রভাব অনস্বীকার্য। এ ব্লগে আলোচনা করা হবে বাংলাদেশের ধর্মীয় অরাজগতায় রাজনীতির কী ভূমিকা রয়েছে এবং কীভাবে এটি সমাজে বিভাজন ও অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।
১. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের জন্ম (১৯৭১) হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতাকে ভিত্তি করে, যেখানে সব ধর্মের মানুষের জন্য সমান অধিকার ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছিল। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা যুক্ত থাকলেও, ১৯৭৫-এর পর বিভিন্ন সামরিক ও রাজনৈতিক সরকারের সময়কাল ধর্মীয় রাজনীতির প্রতি নমনীয়তা ও উৎসাহ দেখা যায়।
১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান ইসলামী দলসমূহের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন এবং ১৯৮৮ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন — এই ঘটনাগুলো ধর্মীয় রাজনীতিকে মূলধারায় প্রতিষ্ঠিত করে।
২. রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের ব্যবহার
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মকে অনেক সময় ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে ধর্মীয় সংগঠন কিংবা নেতাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়, যা ধর্মকে রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করে। এই ধরনের দৃষ্টান্ত দেখা গেছে:
- হেফাজতে ইসলামের উত্থান ও রাজনৈতিক প্রভাব: ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরের ঘটনার পর থেকে হেফাজত ইসলাম একটি প্রভাবশালী ধর্মীয় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বিভিন্ন সময় সরকার এই সংগঠনের সঙ্গে আপস করেছে, যা তাদের দাবি ও কর্মকাণ্ডকে আরও জোরদার করেছে।
- ব্লগার হত্যা ও মুক্তচিন্তার দমন: ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে একাধিক মুক্তমনা ব্লগার ও লেখককে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে হত্যা করা হয়। এসব ঘটনার পেছনে ধর্মীয় উগ্রবাদ যেমন দায়ী, তেমনি রাজনীতিকদের নীরবতা বা পরোক্ষ সমর্থন এসব হত্যাকে উসকে দিয়েছে।
৪. রাজনীতির দ্বিমুখিতা ও রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়া
ধর্মীয় সহিংসতা বা উগ্রতা রোধে রাষ্ট্র বা সরকার একদিকে সহনশীলতার কথা বললেও, অন্যদিকে রাজনৈতিক চাপ বা স্বার্থে জড়িত গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়। ফলে ধর্মীয় মৌলবাদীরা উৎসাহিত হয়, এবং জনগণের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয়।
৫. সমাধানের পথ
ধর্মীয় অরাজকতা রোধে রাজনীতির দায়িত্বশীল ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি। কিছু করণীয় হতে পারে:
- ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করা
- সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা
- ধর্মীয় উগ্রতা রোধে কঠোর আইন প্রয়োগ
- শিক্ষা ও গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা
- বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা
বাংলাদেশে ধর্মীয় অরাজগতা নিছক ধর্মীয় বিশ্বাসের ফল নয়; এর পেছনে রাজনৈতিক হিসাব, শক্তির খেলা এবং ক্ষমতার লোভ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ধর্মীয় অনুভূতিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বন্ধ না হলে সমাজে বিভাজন, ঘৃণা ও সহিংসতা আরও বৃদ্ধি পাবে। একটি বাস্তবিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক সংস্কৃতিই পারে এই অরাজকতা থেকে জাতিকে রক্ষা করতে।