বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে একদিকে নারী অগ্রগতির নানা উদাহরণ তুলে ধরে, অন্যদিকে সমাজ কাঠামোতে এমন এক পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা প্রোথিত রয়েছে যা নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই দ্বিচারিতার একটি উদাহরণ হতে পারে একই সংসদে নারী প্রধানমন্ত্রী ও নারী শ্রমিকের নির্যাতনের সহবাস। এ যেন একদিকে পদ্মা সেতুতে নারীর নেতৃত্ব, অন্যদিকে রিকশার পেছনে “বউ পেটানো আমাদের সংস্কৃতি” লেখা বাস্তবতা।
নারীর অধিকার ও সম্মান নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে নানা উচ্চারণ থাকলেও বাস্তবতা বহুক্ষেত্রেই তা থেকে বিচ্ছিন্ন। ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ৩৭.৭% (ILO)। যদিও এটি আগের দশকের তুলনায় কিছুটা বৃদ্ধি, তবে এখনও পুরুষদের তুলনায় তা অনেক কম। অথচ UNDP-এর এক জরিপে দেখা গেছে, কর্মজীবী নারীরা পুরুষদের চেয়ে গড়ে ৬৪% বেশি ঘরের কাজ করে থাকেন, যেটি অর্থনৈতিকভাবে অদৃশ্য থাকলেও তাদের ক্লান্তি, সময় ও সৃজনশীলতা নষ্ট করে দেয়।
আইন ও নীতিমালার দিক থেকে বাংলাদেশে নারীদের জন্য অসংখ্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (২০০০), পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইন (২০১০), এবং স্থানীয় সরকারে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ব্যবস্থা। তবে Amnesty International-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, এই আইনগুলোর কার্যকর প্রয়োগ এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধে বিচারপ্রাপ্তির হার মাত্র ৩%–৫% এর মধ্যে। ২০২৩ সালে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে প্রায় ১৩৫০টির মতো (Odhikar রিপোর্ট), কিন্তু মামলা দায়ের হয়েছে এর অর্ধেকেরও কম, আর দণ্ডিত হয়েছে মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন। আইন আছে, কিন্তু কার্যকারিতা নেই—এটাই আমাদের নারী নিরাপত্তার বাস্তবচিত্র।
শুধু আইন নয়, সামাজিক মনস্তত্ত্বেও নারীর অবস্থান বৈষম্যমূলক। ছোটবেলা থেকে মেয়েরা শিখে বড় হয় “তুই মেয়ে মানুষ, তোর কাজ রান্না শেখা”, আর ছেলেরা শোনে “তুই তো ছেলে, কাঁদিস কেন?” এই ধরণের সাংস্কৃতিক শর্তায়ন পুরুষকে কর্তৃত্বপ্রিয় করে তোলে এবং নারীকে আত্মপরাজিত। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৭২% নারী মনে করেন স্বামী যদি স্ত্রীকে মারে, তবে কোনো না কোনোভাবে স্ত্রীই দায়ী (UNICEF, 2022)। এটি কেবল নির্যাতনের বৈধতা নয়, বরং নিজেদের অধিকারবোধ হারিয়ে ফেলার এক ভয়ঙ্কর সামাজিক চিত্র।
ধর্ম ও সংস্কৃতির অপব্যাখ্যাও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে বড় বাধা। ইসলাম নারীকে শিক্ষা ও সম্পত্তির অধিকার দিয়েছে, কিন্তু বাস্তবে ওয়ারিশি সম্পত্তিতে মেয়েরা প্রায়শই বঞ্চিত হন। নারীর সম্পত্তির অধিকার সংক্রান্ত মামলা বছরের পর বছর ঝুলে থাকে, আর ভাইয়েরা বলে—”বোন তো নিজের সংসার পেয়ে গেছে, এখন আর সম্পত্তির দরকার কী?” এ যেন নারীর সত্তা কেবল সংসারেই সীমাবদ্ধ রাখার এক মোক্ষম কৌশল।
নারীর প্রতি সহিংসতা কেবল শারীরিক বা অর্থনৈতিক নয়—এর গভীরে রয়েছে এক মনস্তাত্ত্বিক দমননীতি। নারীদের পোশাক, চলাফেরা, এমনকি হাসির ধরণ নিয়েও মন্তব্য করা হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় নারীদের প্রতি ট্রল, বিকৃত ছবি শেয়ার, এবং কণ্ঠরোধ করার চর্চা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। এসব যেন পুরুষতন্ত্রের ডিজিটাল রূপ। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে সাইবার অপরাধের শিকার হওয়া ভুক্তভোগীদের মধ্যে প্রায় ৮৩% ছিলেন নারী (Bangladesh Cyber Crime Awareness Foundation)।
তবে আশার কথাও আছে। নারীরা লড়ছেন—প্রতিদিন, প্রতিক্ষণে। রোকেয়া থেকে শুরু করে আজকের দিনেও যে নারীরা ক্ষুদ্র ব্যবসা করছেন, সাংবাদিকতা করছেন, কোর্টে লড়ছেন কিংবা গ্রামে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হচ্ছেন—তাঁরা প্রত্যেকেই একেকজন সামাজিক প্রতিবিপ্লবী। তবু প্রশ্ন থাকে, তাঁদের এই লড়াই কেন এখনো কেবল “ব্যতিক্রম” হিসেবে দেখা হয়? কেন এটি এখনো স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারেনি?
নারীর ক্ষমতায়ন মানে কেবল তাঁর হাতে কিছু অর্থ তুলে দেওয়া নয়। এটি একটি মানসিক বিপ্লব—যেখানে পুরুষ নারীর সমানাধিকারকে নিজের মর্যাদার হুমকি মনে করবে না। সমাজ তখনই বদলাবে, যখন বাবা তার ছেলেকে বলবে, “তুই রান্না শেখ, তোর বোনও তো শিখছে”, কিংবা একজন স্বামী যখন স্ত্রীর সাফল্যে ঈর্ষা নয়, গর্ব অনুভব করবে।
বাংলাদেশের সমাজের গভীরে গাঁথা এই পুরুষতন্ত্রকে ভাঙতে হলে কেবল আইন নয়, প্রয়োজন সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন। এবং এই পরিবর্তন শুরু করতে হবে পরিবার থেকে, পাঠ্যপুস্তক থেকে, নাটক-সিনেমা থেকে, এমনকি ধর্মীয় আলোচনার টেবিল থেকেও।
কারণ, নারী অধিকার কোনো বিশেষ সুযোগ নয়, এটি একটি জন্মগত মানবিক অধিকার। আর এই অধিকার নিশ্চিত করা কেবল নারীর জন্য নয়, বরং এক মানবিক রাষ্ট্র ও সভ্য সমাজ গঠনের জন্য অপরিহার্য।