বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীদের প্রতিদিনই লড়তে হয় নানা ধরনের সামাজিক বিধিনিষেধ, মনোভাব এবং আচরণের বিরুদ্ধে। এসবের মধ্যে অন্যতম হলো মোরাল পুলিসিং — এক ধরনের অঘোষিত সামাজিক পুলিশি তৎপরতা, যার মাধ্যমে নারীদের চলাফেরা, পোশাক, কথা বলা, এমনকি অনলাইন কার্যক্রম পর্যন্ত ‘নৈতিকতা’র ছাঁকনি দিয়ে বিচার করা হয়।
মোরাল পুলিসিং কী এবং এটি কোথা থেকে আসে?
মোরাল পুলিসিং মূলত এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজেদের ‘নৈতিক মাপকাঠি’র মানদণ্ডে অন্যের জীবনযাপন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। বাংলাদেশে এটি বেশিরভাগ সময় নারীদের ক্ষেত্রেই প্রয়োগ হয়। রাস্তাঘাটে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সামাজিক মাধ্যমে — সব জায়গাতেই নারীদের পোশাক, ব্যবহার, বন্ধুতা, এমনকি কর্মক্ষেত্রে কাজ করার ধরন নিয়ে মন্তব্য, তিরস্কার বা হেনস্তার শিকার হতে হয়।
এই মানসিকতা এসেছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, ধর্মীয় অপব্যাখ্যা, এবং সংস্কৃতির নামে রক্ষণশীল মানসিকতা থেকে। অনেক সময় গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যম এই প্রবণতাকে আরও উসকে দেয়।
মোরাল পুলিসিংয়ের প্রভাব
- মানসিক চাপ ও আত্মবিশ্বাসে আঘাত – বারবার মন্তব্য ও হেনস্তা নারীদের আত্মসম্মানে আঘাত হানে।
- স্বাধীন চলাফেরার সীমাবদ্ধতা – নারীরা নিজের পছন্দমতো পোশাক বা পরিবেশে চলতে ভয় পায়।
- শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে বাধা – অনেক নারী শুধুমাত্র সামাজিক মানসিকতার ভয়ে বাইরে কাজ করতে চান না।
- সাইবার বুলিং – সামাজিক মাধ্যমে নারীপ্রোফাইল লক্ষ্য করে ‘শালীনতা’র দোহাই দিয়ে আক্রমণ করা হয়।
কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
১. আইনি পদক্ষেপ জোরদার করা
মহিলা ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ বিদ্যমান আইনগুলো কার্যকরভাবে প্রয়োগ করলে অনলাইন এবং অফলাইনে হেনস্তাকারীদের শাস্তির মুখোমুখি করা সম্ভব। পুলিশ প্রশাসনের নারীবান্ধব আচরণও জরুরি।
২. জনসচেতনতা তৈরি
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে লিঙ্গ সমতা, মানবাধিকার ও নাগরিক চেতনা বিষয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালু করা যেতে পারে। মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়াকে ইতিবাচক বার্তা প্রচারে ব্যবহার করা উচিত।
৩. নারীর নিজস্ব কণ্ঠস্বর জোরালো করা
নারীদের কথা বলার জায়গা তৈরি করতে হবে — যেমন ব্লগ, ইউটিউব চ্যানেল, পডকাস্ট, কর্মশালা। যখন নারী নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেয়, তখন তা অন্য নারীর জন্য প্রেরণাদায়ী হয়ে ওঠে।
৪. পুরুষদের সম্পৃক্ত করা
এটা কেবল নারীর লড়াই নয়। পিতৃতন্ত্রের অবসান ঘটাতে হলে পুরুষদেরও দায়িত্ব নিতে হবে। পুরুষদের মধ্যে সহানুভূতি, সমতা ও সহমর্মিতা বাড়াতে কাজ করতে হবে পরিবার ও শিক্ষাঙ্গনে।
৫. সোশ্যাল মিডিয়া রিপোর্টিং ও কাউন্টার ন্যারেটিভ
সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রল বা হেনস্তাকারীদের রিপোর্ট করে এবং গঠনমূলক পোস্টের মাধ্যমে ‘কাউন্টার ন্যারেটিভ’ দাঁড় করিয়ে মোরাল পুলিসিং-এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়া সম্ভব।
মোরাল পুলিসিং সমাজে নারী-পুরুষের বৈষম্যকে আরও গভীর করে তোলে। এটি বন্ধ করতে হলে চাই আইনি কাঠামোর বাস্তব প্রয়োগ, সামাজিক চিন্তার পরিবর্তন, এবং নারী-পুরুষ উভয়ের সচেতন অংশগ্রহণ। ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং নারীর মর্যাদা রক্ষা করা শুধু নারীর অধিকার নয়, এটি একটি সভ্য ও মানবিক সমাজের অন্যতম ভিত্তি।