বাংলাদেশের সংস্কৃতির এক গর্বিত অংশ হলো বাউল গান ও লালন দর্শন। এই গানে মানবতাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা, আত্মসন্ধান, ও যুক্তিনির্ভর চিন্তার প্রতিফলন ঘটে। কিন্তু সময় ও সমাজের একাংশ এমনভাবে বদলে গেছে যে, এই শান্তিপূর্ণ ও আত্মিক সাংস্কৃতিক ধারা আজ মৌলবাদী গোষ্ঠীর হুমকির মুখে। কয়েক বছর আগে কুষ্টিয়ায় লালন শাহ’র আখড়াবাড়ি এবং বাউল সম্প্রদায়ের কিছু গান ও চর্চার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে একদল মৌলবাদী গোষ্ঠী আন্দোলন করে এবং বাউলদের আক্রমণ করে।
এখানেই প্রশ্ন আসে—কেন এই গোষ্ঠীগুলো এমন এক সৃষ্টিশীল, মানবতাবাদী ও সম্পূর্ণ অ-রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে এতটা ভয় পায়? কেন তারা মতবিরুদ্ধ কিছুকে সহজে গ্রহণ করতে পারে না?
ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ
কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালনের আখড়াবাড়িতে অনুষ্ঠিত এক বাউল উৎসবে, কিছু মৌলবাদী গোষ্ঠী উপস্থিত হয়ে অভিযোগ তোলে যে, “বাউল গান ইসলামের নামে অবমাননা করে”, “ওরা শরিয়তের বিরুদ্ধে কথা বলে”। এরপর তারা বিভিন্ন মাধ্যমে ধর্মীয় উসকানিমূলক বক্তব্য ছড়ায়, লালনের মূর্তি ভাঙার দাবি তোলে এবং কিছু বাউলকে শারীরিকভাবেও হেনস্তা করে।
কেন এই প্রতিক্রিয়া? – বিশ্লেষণ
১. সাংস্কৃতিক ভিন্নতা মানতে অক্ষমতা
লালন বা বাউল দর্শন মূলত আত্মদর্শনের কথা বলে, যেখানে ধর্মকে প্রশ্ন করার অধিকার রয়েছে। এই গানে শরিয়ত, তরিকত বা সমাজের দ্বিচারিতা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা হয়। কিন্তু মৌলবাদী গোষ্ঠী প্রশ্নহীন আনুগত্যে বিশ্বাসী। ভিন্নভাবে চিন্তা করা মানেই তাদের কাছে “ইসলামবিরোধী”।
২. “মতবিরুদ্ধ মানেই শত্রু” মনোভাব
এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ‘আমরা বনাম তারা’ মানসিকতা এতটাই গভীরে গেঁথে আছে যে, তারা ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক ভিন্নমতকে “অস্তিত্বের হুমকি” হিসেবে দেখে। তাই তারা কেবল অস্বীকারই করে না, বরং আক্রমণাত্মক হয়।
৩. ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার
বাউলদের আঘাত করার মাধ্যমে এরা সাধারণ মানুষের ধর্মীয় আবেগে আগুন জ্বালাতে চায়। এটা তাদের পছন্দের পন্থা—যেকোনো ‘ভিন্ন’ কিছুকে “ইমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র” বলে তুলে ধরে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়।
৪. মূর্খতা ও বিকৃত ব্যাখ্যার উপর নির্ভরশীলতা
লালন শাহ নিজে একজন সাধক ছিলেন, যিনি ইসলাম, হিন্দু—সবকিছুকে মিলিয়ে একটি মানবিক ধর্মের কথা বলেছেন। কিন্তু মৌলবাদীরা লালনের বক্তব্যের খণ্ডিত অংশ নিয়ে গুজব ছড়ায়, কারণ তাদের শিক্ষা ও জ্ঞানের ভিত্তি সংকীর্ণ এবং বিকৃত।
এই বাস্তবতা আমাদের কী শেখায়?
এই ঘটনাটি কেবল একটি আঞ্চলিক উত্তেজনা নয়, বরং একটি গভীর সামাজিক সংকেত। সমাজে এখনো এমন গোষ্ঠী রয়েছে, যারা সহনশীলতা, প্রশ্ন করার অধিকার, মুক্তচিন্তা ও সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদকে সহ্য করতে পারে না। তারা একটি ‘একরৈখিক চিন্তার সমাজ’ গড়তে চায়—যেখানে কেবল তাদের মতো করে চিন্তা করলেই তুমি গ্রহণযোগ্য।
লালন ও বাউল দর্শনের উপর মৌলবাদীদের হামলা ছিল মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে সরাসরি আঘাত। এটি দেখায়, বাংলাদেশে উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলো ভিন্নমতকে মেনে নিতে কেন ব্যর্থ—কারণ তারা প্রশ্নবিদ্ধ হতে চায় না, তারা নিজেদের মতকে একমাত্র “সত্য” মনে করে এবং ভিন্ন কিছু দেখলেই সেটিকে দমন করতে চায়।
বাংলাদেশের সমাজ যদি সহনশীল, যুক্তিনির্ভর ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে মূল্য দেয়—তবে আমাদের দায়িত্ব হবে এই উগ্র মনোভাবকে যুক্তি, শিক্ষা ও মানবিকতা দিয়ে প্রতিহত করা।