বর্তমান সময়ে যুক্তি, বিজ্ঞান, মানবাধিকার ও সামাজিক সচেতনতা নিয়ে আলোচনার সুযোগ যতটা বেড়েছে, ঠিক ততটাই বেড়েছে এর বিরোধিতাও। বাংলাদেশে বা উপমহাদেশে এখনো এমন বহু বিষয় রয়েছে যেগুলো নিয়ে কথা বলাকে ট্যাবু বা অপরাধ বলে মনে করা হয়। বিচিন্তা একটি অনলাইন ডিসকাশন ফোরাম, যেখানে সমাজের বিতর্কিত, উপেক্ষিত ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়। এন্টি সেমিটিজম, নারী অধিকার, সমকামীতা, লিঙ্গ সমতা, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ এখানে তোলা হয় যুক্তির আলোকে।
তবে এই ফোরামের কর্মকাণ্ডকে ঘিরে একদল কট্টরপন্থী মানুষের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তাদের অভিযোগ—বিচিন্তা তরুণ প্রজন্মকে ‘বিপথে’ পরিচালিত করছে। কিন্তু সত্যিই কি তাই?
এই লেখায় আমরা খতিয়ে দেখব বিচিন্তার প্রকৃত উদ্দেশ্য কী, কেন এটি প্রয়োজনীয় এবং কেন যুক্তিভিত্তিক মুক্তচিন্তা সমাজের অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য।
বিচিন্তা কী এবং কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ
বিচিন্তা কোনো উসকানিমূলক প্ল্যাটফর্ম নয়, বরং এটি একটি মুক্তমঞ্চ যেখানে ভিন্নমত ও প্রশ্ন করার অধিকারকে উৎসাহিত করা হয়। সমাজের প্রচলিত রীতিনীতিগুলোর পেছনের যুক্তি খোঁজা, বৈজ্ঞানিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করা—এই প্ল্যাটফর্মের মূল ধারা।
এই ধরনের আলোচনার গুরুত্ব বহুস্তরীয়:
- মানসিক মুক্তি: সমাজের চাপিয়ে দেওয়া চিন্তার বাইরে এসে নিজের মতো করে ভাবার সুযোগ তৈরি করে।
- অবদমিত কণ্ঠস্বরের জায়গা: নারীরা, সংখ্যালঘুরা বা এলজিবিটিকিউ+ সম্প্রদায়ের মানুষদের মতপ্রকাশের একটি নিরাপদ পরিসর তৈরি হয়।
- সমাজে যুক্তির চর্চা বাড়ে: অন্ধ আনুগত্য নয়, বরং আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।
কেন কট্টরপন্থীরা এর বিরোধিতা করে
বিচিন্তার আলোচ্য বিষয়গুলো—যেমন ধর্মীয় গোঁড়ামি, নারী স্বাধীনতা, যৌনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা—এই সবই বহু মানুষের জন্য অস্বস্তিকর হতে পারে, বিশেষ করে যারা সামাজিক ক্ষমতার ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ হারাতে ভয় পায়। কট্টরপন্থীরা সাধারণত তিনটি কারণে এর বিরোধিতা করে:
- ভয়ের রাজনীতি: তারা মনে করে, প্রশ্ন করার অধিকার সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে।
- তথ্য-অজ্ঞতা: অনেকেই যে বিষয়ে বিরক্ত হন, তারা সেসব বিষয়ে পড়েন না বা বোঝেন না। ফলে অপপ্রচার সহজ হয়।
- ক্ষমতা হারানোর শঙ্কা: যে সমাজে মানুষ নিজের মতো করে ভাবতে শেখে, সেখানে নিয়ন্ত্রণমূলক আদর্শ টিকে থাকতে পারে না।
‘বিপথগামীতা’—আসলে কার সংজ্ঞায়?
কিছু বিরোধীরা দাবি করে যে বিচিন্তা তরুণদের ‘বিপথে’ নিচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—বিপথগামীতা কার সংজ্ঞা অনুযায়ী? যদি নিজের পরিচয় নিয়ে চিন্তা করা, যুক্তি দিয়ে প্রশ্ন তোলা, সংখ্যালঘুর অধিকারের পক্ষে কথা বলা ‘বিপথগামীতা’ হয়, তাহলে সেই সমাজব্যবস্থার ভিত্তি কতটা ন্যায্য?
যদি তরুণরা যৌন সম্মতি, নারীর শরীরের অধিকার, ধর্মীয় সহনশীলতা, এবং বিজ্ঞানসম্মত চিন্তা নিয়ে আলোচনা করে, তবে সেটিকে বিপথ নয় বরং পথের খোঁজ বলা উচিত।
বিচিন্তা-র মতো প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজনীয়তা
সমাজের অগ্রগতির ইতিহাস দেখলে দেখা যায়—প্রতিটি বড় পরিবর্তনের পেছনে বিতর্ক, প্রশ্ন এবং যুক্তিভিত্তিক চিন্তার অবদান রয়েছে। গ্যালিলিও থেকে বেগম রোকেয়া পর্যন্ত—তাঁদের সবাইকেই একসময় “বিপথগামী” বলা হয়েছিল। কিন্তু ইতিহাস জানে, তাঁদের চিন্তা সমাজকে আলোর পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
আজকের বিচিন্তা সেই ঐতিহ্যের অংশ। এটি কোনো চূড়ান্ত সত্য প্রতিষ্ঠা করে না, বরং সত্য খোঁজার প্রক্রিয়াকে গুরুত্ব দেয়।
বিচিন্তা একটি প্রতিবাদ নয়, বরং একটি প্রস্তাব—একটি যুক্তির মাধ্যমে ভাবার প্রস্তাব। সমাজে আলোচনার, মতপার্থক্যের, এবং সহনশীলতার সংস্কৃতি গড়ে তোলার একটি প্রয়াস। যারা এটি থামিয়ে দিতে চায়, তারা আসলে অন্ধকারেই সমাজকে বেঁধে রাখতে চায়।
এই সময়টা এমন এক সময়, যখন ভয় নয়—যুক্তি দিয়ে পথ খোঁজার দরকার। বিচিন্তার মতো সাহসী প্ল্যাটফর্মগুলোর প্রয়োজন আরও বেশি, আরও বিস্তৃত পরিসরে।