July 15, 2025

Banner Image

বিচিন্তা

বিবর্তনবাদ তত্ত্ব ও বাংলাদেশের জনমানসে তার প্রতিফলন: এক গভীর দ্বন্দ্বের অনুসন্ধান

বিজ্ঞান ও ধর্ম — দুটি জগৎ, দুটি পদ্ধতি। একটির ভিত্তি পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা ও যুক্তিতে; অন্যটির ভিত্তি বিশ্বাস, আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিক দর্শনে। এই দুটি জগতের সংযোগস্থলে যখন বিবর্তনবাদ তত্ত্বের মতো একটি শক্তিশালী বৈজ্ঞানিক ধারণা এসে দাঁড়ায়, তখন অনেক সমাজেই দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই দ্বন্দ্ব অনেক বেশি স্পষ্ট এবং জটিল।

বিবর্তনবাদ বা ডারউইনের তত্ত্ব আধুনিক জীববিজ্ঞানের মূল ভিত্তিগুলোর একটি। ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত “On the Origin of Species” গ্রন্থে চার্লস ডারউইন প্রাণীর ধাপে ধাপে পরিবর্তন ও অভিযোজনের যে ব্যাখ্যা দেন, তা পরবর্তীতে বহু গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ও সমর্থিত হয়। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, জীবজগতের বৈচিত্র্য বহু বছরের জেনেটিক পরিবর্তন, প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং অভিযোজনের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে। মানুষ নিজেও এই প্রক্রিয়ার অংশ — একটি নির্দিষ্ট পূর্বপুরুষ থেকে ধাপে ধাপে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমান রূপে পৌঁছেছে।

কিন্তু বাংলাদেশের মতো একটি ধর্মপ্রধান ও ঐতিহ্যভিত্তিক সমাজে এই তত্ত্বটি সহজভাবে গৃহীত হয়নি। এখানকার মানুষদের অধিকাংশই সৃষ্টিতত্ত্বে বিশ্বাসী — অর্থাৎ, একজন সর্বশক্তিমান স্রষ্টা মানুষকে সরাসরি সৃষ্টি করেছেন, এমন বিশ্বাস বহু প্রজন্ম ধরে ধরে চলে আসছে। ফলত, বিবর্তনের ধারণাটি ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে বিবেচিত হয়।

ধর্মীয় জড়তা ছাড়াও এই দ্বন্দ্বের পিছনে রয়েছে আরও কিছু বাস্তবিক ও কাঠামোগত কারণ। শিক্ষাব্যবস্থা এক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। জীববিজ্ঞানের পাঠ্যবইয়ে বিবর্তন তত্ত্বের অধ্যায় থাকলেও, তা কেবল বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকে। পাঠদান ও বোঝানোর ক্ষেত্রে শিক্ষকেরা অনেক সময় নিজেরাও সংকোচ বোধ করেন, বিশেষ করে যখন ছাত্রছাত্রীরা তা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্ন করে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা একদিকে বিজ্ঞান পড়ছে, আবার অন্যদিকে মনে মনে তা অগ্রহণযোগ্য মনে করছে। এতে করে তারা দ্বৈত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বেড়ে ওঠে — বিজ্ঞান শ্রেণিকক্ষে শেখার বিষয়, কিন্তু বাস্তব বিশ্বাসের জায়গায় নয়।

বাংলাদেশে ২০১৭ সালে করা পিউ রিসার্চ সেন্টারের একটি জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ২৩% মানুষ মনে করেন মানুষ বিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে। বাকি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বিশ্বাস করেন, মানুষ সরাসরি ঈশ্বরের সৃষ্টি। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয় দেশের জনমনে বিবর্তন তত্ত্বের গ্রহণযোগ্যতা কত সীমিত।

এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো — অনেক মানুষ বিবর্তন তত্ত্বকে ভুলভাবে বোঝে। যেমন, অনেকেই ভাবে বিবর্তন মানে “মানুষ বানর থেকে এসেছে” — যা একটি ভুল ব্যাখ্যা। প্রকৃতপক্ষে, বিবর্তনবাদ বলে না যে মানুষ সরাসরি বানর থেকে এসেছে, বরং মানুষ ও বর্তমান বানরের একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ ছিল, যেখান থেকে দুটি ভিন্ন শাখায় বিবর্তিত হয়েছে। এই ভুল তথ্য ও অপব্যাখ্যার কারণেই অনেকেই এই তত্ত্বকে অযৌক্তিক বা হাস্যকর বলে মনে করেন।

অন্যদিকে, ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে সম্পর্ক কি সবসময় বিরোধপূর্ণ? একথা বলা যাবে না। বিশ্বের বহু বিজ্ঞানী, যারা গভীরভাবে ধর্মবিশ্বাসী, তারা বিবর্তন তত্ত্বকে তাদের বিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করেন না। উদাহরণস্বরূপ, ড. ফ্রান্সিস কলিন্স — যিনি মানব জিনোম প্রকল্পের প্রধান ছিলেন — একজন খ্রিস্টান, কিন্তু তিনি বিবর্তনের প্রবক্তা। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকেও এমন বহু মনীষী আছেন, যারা বলেন — কোরআনে কোথাও সরাসরি বিবর্তনকে অস্বীকার করা হয়নি। বরং কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে “ধাপে ধাপে সৃষ্টি”, “চিন্তা কর”, “পর্যবেক্ষণ কর” ইত্যাদি নির্দেশ রয়েছে, যা বিজ্ঞানের অনুসন্ধানমূলক দৃষ্টিভঙ্গিকে উৎসাহিত করে।

বাংলাদেশে এই দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য প্রয়োজন একটি সুস্থ ও যুক্তিপূর্ণ পরিবেশ, যেখানে বিজ্ঞান ও ধর্মকে মুখোমুখি না দাঁড় করিয়ে পাশাপাশি চিন্তা করা যাবে। সেজন্য প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার। শিক্ষকরা যেন সাহস ও যুক্তির সঙ্গে বিবর্তন তত্ত্ব পড়াতে পারেন, সেজন্য প্রশিক্ষণ ও উপযুক্ত পাঠ্যউপকরণ প্রয়োজন। একইসঙ্গে, মিডিয়াতে — বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় — বিজ্ঞানভিত্তিক সহজবোধ্য কনটেন্ট তৈরি করে তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করা যেতে পারে।

আমরা যদি বিবর্তন তত্ত্বকে ধর্মের প্রতিপক্ষ না ভেবে, বিজ্ঞানময় জগৎকে বোঝার একটি পথ হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে দ্বন্দ্ব অনেকটাই লাঘব হবে।

সর্বোপরি, সত্যকে জানতে হলে তা নিয়ে প্রশ্ন করতে হবে, চিন্তা করতে হবে, এবং নিজের বিশ্বাসকেও প্রশ্ন করার সাহস থাকতে হবে। বিবর্তনবাদের মতো একটি তত্ত্ব আমাদের সেই চিন্তার জগৎকে উন্মোচিত করে দেয় — যেখানে মানুষ জানে, সে একদিন কোথা থেকে এসেছে, কীভাবে এসেছে, এবং ভবিষ্যতে কোথায় যেতে পারে।

Share: Facebook Twitter Linkedin
Leave a Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *