বাংলাদেশের ইতিহাসে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের শাসনামল এক ভয়াবহ দমন-পীড়নের সময়কাল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে উঠেছে। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার, শান্তিপূর্ণ সমাবেশে গুলি চালানো—এসব অপরাধে রাষ্ট্রের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার প্রমাণ সময় ও ইতিহাস বারবার উপস্থাপন করেছে।
এইসব অপরাধ শুধুমাত্র প্রশাসনিক “অতিরিক্ত ব্যবহার” হিসেবে দেখলে তা হবে ভয়াবহ মানবাধিকারের লঙ্ঘনকে তুচ্ছ করা। বরং এগুলো ছিল সুপরিকল্পিত, কাঠামোগত, এবং ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার নীলনকশার অংশ। আর এই অপরাধগুলোর বিচার সাধারণ সামরিক আদালত বা বাহিনীর অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থার মাধ্যমে নয়, বরং নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে গঠিত একটি স্বাধীন ‘বিশেষ ট্রাইব্যুনালের’ মাধ্যমে হওয়া জরুরি।
কেন সামরিক ট্রাইবুনাল নয়?
১. স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার অভাব:
সামরিক আদালত মূলত বাহিনীর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার জন্য গঠিত, যেখানে বাহিনীর হায়ারার্কির প্রতি আনুগত্যই বিচারিক প্রক্রিয়ার বড় চালিকাশক্তি। এই ধরনের কাঠামোয় বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে সত্যিকার বিচার হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।
২. বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে অপরাধ:
রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সদস্যরা যে অপরাধগুলো করেছেন, তা নিরীহ নাগরিকদের বিরুদ্ধে—যেমন: রাতের অন্ধকারে তুলে নেওয়া, র্যাব-পুলিশের ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যা, রাজনৈতিক কর্মীদের নিখোঁজ করা ইত্যাদি। এই অপরাধ বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে হওয়ায় এর বিচারও হওয়া উচিত নাগরিক সমাজের তত্ত্বাবধানে গঠিত স্বাধীন ট্রাইব্যুনালে।
৩. আন্তর্জাতিক মানদণ্ড:
গণহত্যা, গুম, এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ আন্তর্জাতিক অপরাধ (International Crimes)। আন্তর্জাতিক বিচার প্রক্রিয়ার মানদণ্ড অনুসরণ করেই এমন ট্রাইব্যুনাল গঠিত হওয়া উচিত। যেমনটি হয়েছিল রুয়ান্ডা, যুগোশ্লাভিয়া কিংবা সিয়েরা লিওনের ক্ষেত্রে।
বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের যুক্তি
১. জনগণের আস্থা ও অংশগ্রহণ:
একটি স্বতন্ত্র, নিরপেক্ষ ট্রাইব্যুনাল জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারে। এতে ভুক্তভোগী পরিবাররা সাক্ষ্য দিতে আগ্রহী হবে, তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা সহজ হবে।
- রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বিচার:
বিশেষ ট্রাইব্যুনাল আইনসভার অধীন হলেও বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতায় পরিচালিত হবে। ফলে সরকারের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে এটি নিরাপদ থাকবে—যা সামরিক বা পুলিশি কাঠামোতে সম্ভব নয়। - ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন:
এই ট্রাইব্যুনাল ভবিষ্যতের জন্য একটি সতর্ক সংকেত হবে: রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে কেউ চাইলেই জনগণের বিরুদ্ধে অপরাধ করে দায়মুক্তি পাবে না।
প্রস্তাবিত ট্রাইব্যুনাল কাঠামো কেমন হতে পারে?
- সাবেক বিচারপতি, মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ, আন্তর্জাতিক আইনজীবী ও নাগরিক সমাজ প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত একটি প্যানেল
- বিশেষ তদন্ত সংস্থা যা সরকারের নিয়ন্ত্রণে নয়
- প্রবেশযোগ্য তথ্যব্যবস্থা, যাতে জনগণ জানতে পারে মামলা কোথায় কী অবস্থায় আছে
- সাক্ষী সুরক্ষা কর্মসূচি, যা ভুক্তভোগী ও সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে
পরিশেষে এটাই বলার থাকে, ফ্যাসিস্ট শাসনের নামে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস কোনোভাবেই ক্ষমার যোগ্য নয়। যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়েছে, তাদের বিচার সামরিক ট্রাইব্যুনালের মতো বন্ধ গেটের ভেতরে নয়, বরং স্বাধীন ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে হতে হবে। এটাই ইতিহাসের দাবি, এটাই ন্যায়বিচারের দাবি।