July 15, 2025

Banner Image

বিচিন্তা

ভিন্নতা নয়, মানবতা—বাংলাদেশে সমকামী ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের প্রতি ঘৃণার মনোভাবের শিকড়

বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা একদিকে যতই আধুনিকতার দিকে এগোচ্ছে, অন্যদিকে কিছু মানবিক বিষয়ে এখনো রয়ে গেছে চরম রকমের পশ্চাৎপদতা। এর একটি বড় উদাহরণ—সমকামী (LGBTQ+) ও তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) মানুষদের প্রতি বৈষম্যমূলক ও ঘৃণামূলক মনোভাব। তাদের প্রতি সামাজিক অবহেলা, লাঞ্ছনা, এমনকি সহিংসতাও প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ তারা আমাদেরই মতো মানুষ—শুধু লিঙ্গ পরিচয় ও যৌন প্রবণতায় ভিন্ন।

ধর্ম ও সংস্কৃতির ভুল ব্যাখ্যা: ঘৃণার মূল বীজ?

অনেকেই ধর্মীয় অনুশাসনের দোহাই দিয়ে সমকামী বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অগ্রহণযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করেন। কিন্তু এখানে একটি মৌলিক ভুল আছে—ধর্ম মানবতা শেখায়, ঘৃণা নয়। ইসলামে যেমন বলা হয়েছে “তোমার প্রতিবেশীকে ভালোবাসো”, তেমনি হিন্দুধর্মে আছে “সব প্রাণেই পরমাত্মা বিরাজমান”। কিন্তু আমরা কি প্রকৃতপক্ষে এই ধর্মীয় মূল্যবোধগুলোর চর্চা করি, নাকি নিজেদের ভয়, সংকীর্ণতা ও অজ্ঞতা ঢাকতে ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করি?

শিক্ষার ঘাটতি ও মিডিয়ার ভূমিকা

আমাদের পাঠ্যবইয়ে কখনো শেখানো হয় না যে যৌনতা ও লিঙ্গ পরিচয় একটি বৈচিত্র্যময় বিষয়। ‘ছেলে’ মানে শক্তিশালী, ‘মেয়ে’ মানে নরম স্বভাব—এমন জেন্ডার স্টেরিওটাইপ ছোটবেলা থেকেই গেঁথে দেওয়া হয় মনে। ফলে যারা এই নির্ধারিত বৃত্তের বাইরে যায়, তারা হয়ে ওঠে ‘ভিন্ন’—এবং সেই ভিন্নতা থেকেই জন্ম নেয় ভয়, এবং সেই ভয় থেকেই ঘৃণা।

মিডিয়াও বিষয়টিকে সচেতনভাবে ঠিকভাবে উপস্থাপন করে না। বহু সিনেমা ও নাটকে হিজড়াদের দেখানো হয় হাস্যকর চরিত্র হিসেবে—তাদের উপস্থিতি মানেই জোক বা ভয়। এর ফলে সাধারণ মানুষ তাদের মানুষ নয়, ‘দৃশ্যমান ব্যতিক্রম’ হিসেবে দেখতে শেখে।

বাস্তব চিত্র: পরিসংখ্যান ও নিদর্শন

বাংলাদেশে ২০১৩ সালে সরকার তৃতীয় লিঙ্গকে আইনি স্বীকৃতি দিলেও বাস্তব জীবনে সেই স্বীকৃতির কোনো ছাপ দেখা যায় না। অধিকাংশ হিজড়াই বেঁচে থাকার জন্য ভিক্ষা, নাচ বা যৌনকর্মে যুক্ত হতে বাধ্য হন। চাকরি তো দূরের কথা, তারা শিক্ষা ও চিকিৎসার মৌলিক অধিকার থেকেও প্রায় বঞ্চিত।

এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকায় বসবাসকারী LGBTQ+ তরুণ-তরুণীদের প্রায় ৮২% স্কুলজীবনে সহপাঠীদের হাতে মানসিক বা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর বড় একটা অংশ আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। অথচ এরা সকলেই সমাজে দক্ষ নাগরিক হিসেবে অবদান রাখতে পারত, যদি তারা নিরাপদ পরিবেশ পেত।

ধরা যাক, একটি বাগানে নানা ধরনের ফুল রয়েছে—গোলাপ, বেলি, সূর্যমুখী। যদি বাগানের মালিক শুধু গোলাপকেই ফুল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, তাহলে কি সেটা প্রকৃত বাগান হয়? হয় না। ঠিক তেমনি, সমাজও যদি শুধু নির্দিষ্ট লিঙ্গ পরিচয়কেই স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়, তাহলে সেটা সুস্থ সমাজ নয়। আমরা সবাই মিলে রঙধনুর মতো—প্রত্যেকে ভিন্ন রঙ, কিন্তু একসঙ্গে অপূর্ব সৌন্দর্য।

কী করা দরকার?

১. শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে—লিঙ্গ পরিচয় ও যৌন বৈচিত্র্য বিষয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক ও মানবিক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

২. আইন ও নীতিমালায় বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে—তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি কাগজে নয়, বাস্তবে দেখতে চাই। চাকরি, শিক্ষা, চিকিৎসায় তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

৩. মিডিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে—ঘৃণা বা হাসির বিষয় হিসেবে নয়, হিজড়া ও সমকামী মানুষদের বাস্তব ও সম্মানজনক চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে।

৪. সামাজিক সচেতনতা তৈরি করতে হবে—যুবসমাজকে এগিয়ে আসতে হবে এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে। মানবিক আলোচনা, কর্মশালা, এবং জনসচেতনতামূলক প্রোগ্রামের মাধ্যমে এই মানুষদের প্রতি সহানুভূতির বীজ বপন করতে হবে।

আমরা যদি সমাজে সত্যিকারের সমতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তাহলে আমাদের আগে ঘরের দরজাটাই খুলতে হবে। ভিন্নতা ভয় নয়, সৌন্দর্য। মানুষকে তার যৌনতা বা লিঙ্গ পরিচয়ের ভিত্তিতে নয়, তার মানবিক গুণাবলির ভিত্তিতে মূল্যায়ন করতে শিখতে হবে।

হোক না কেউ সমকামী, হিজড়া, কিংবা ট্রান্সজেন্ডার—প্রথমেই সে মানুষ। আর সেই মানুষকে সম্মান জানানোই হলো সভ্যতার মূল পরিচয়।

Share: Facebook Twitter Linkedin
Leave a Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *