
২০২৪ সালে সামাজিক মাধ্যমে একটি ভিডিও ভাইরাল হয় যেখানে আসিফ মাহতাব, একজন পরিচিত বক্তা ও ইসলাম বিষয়ক আলোচক, ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের নিয়ে একাধিক অবমাননাকর ও বৈষম্যমূলক মন্তব্য করেন। সপ্তম শ্রেনীর পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত শরীফ নামক এক বালকের শরীফা নামক বালিকায় রূপান্তরিত হওয়া বিষয়ক একটি গল্প নিয়ে তিনি চরম বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রদান করেন এবং সেই পাঠ্যবইটি তিনি জনসমক্ষে ছিড়ে ফেলেন। তার বক্তব্যে স্পষ্ট ছিল ঘৃণা, বিদ্বেষ এবং একটি মানবিক-সংবেদনশীল ইস্যুকে অবজ্ঞাসূচকভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা। এই ধরনের বক্তব্য কেবল অজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং এটি সমাজে বিদ্বেষ ও সহিংসতা উসকে দেয়ার জন্য যথেষ্ট বিপজ্জনক।
ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি কারা?
ট্রান্সজেন্ডার (transgender) ব্যক্তি সেই মানুষ, যাদের লিঙ্গ পরিচয় জন্মের সময় নির্ধারিত লিঙ্গের সঙ্গে মিল না-ও থাকতে পারে। এটি কোনো “ট্রেন্ড” নয়, বরং মানুষের পরিচয়ের গভীর এক বাস্তবতা।
✅ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ২০১৯ সালে ট্রান্সজেন্ডার পরিচয়কে আর “মানসিক ব্যাধি” হিসেবে তালিকাভুক্ত না করে এটিকে “লিঙ্গ পরিচয়ের বৈচিত্র্য” হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
➡️ সূত্র: WHO ICD-11, 2019
✅ American Psychological Association বলেছে:
“Being transgender is not a mental disorder. It is a natural variation of human experience.”
আসিফ মাহতাবের বক্তব্য কেন ক্ষতিকর?
১. ঘৃণা উসকে দেয়
ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিরা ইতিমধ্যে সমাজে চরম নিপীড়নের শিকার।
📌 Human Rights Watch এর তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় (বিশেষত বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানে) ট্রান্সজেন্ডারদের প্রতি সহিংসতা, পারিবারিক বর্জন ও অর্থনৈতিক নিপীড়ন ব্যাপকভাবে প্রচলিত।
➡️ HRW Report, 2022
২. ধর্মের অপব্যাখ্যা
ইসলামে প্রতিটি মানুষকে আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
📖 কোরআনের আয়াত (সূরা হুজুরাত, আয়াত ১৩):
“হে মানবজাতি! আমি তোমাদেরকে এক নারী ও পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পারো।”
📚 মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফতোয়া বিভাগ ২০১৬ সালে বলেছে:
“যদি কোনো ব্যক্তি ডাক্তারি ভিত্তিতে ট্রান্সজেন্ডার হন, তবে তার প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করা হারাম।”
৩. আইন ও সংবিধানবিরোধী বক্তব্য
📌 বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে হিজড়াদের “তৃতীয় লিঙ্গ” হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়
➡️ সূত্র: The Daily Star, 2013
📌 ২০১৯ সালের একটি UNDP রিপোর্ট অনুসারে, বাংলাদেশে আনুমানিক ১০,০০০+ ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি বসবাস করেন, যাদের অধিকাংশই কর্মসংস্থান, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত।
➡️ UNDP Bangladesh Report, 2019
আমাদের করণীয় কী?
✅ ঘৃণার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া
ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মধ্যে পড়ে না। এটি ঘৃণাপূর্ণ বক্তব্য (hate speech), যা সংবিধান ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে।
✅ সচেতনতা ও শিক্ষা বৃদ্ধি
📌 Pew Research Center এর 2021 সালের এক জরিপে দেখা যায়, যেসব মানুষ ট্রান্সজেন্ডারদের সম্পর্কে ঘনিষ্ঠভাবে জানেন, তাদের মধ্যে ৭৩% ট্রান্সজেন্ডার অধিকারকে সমর্থন করেন।
✅ আইনি পদক্ষেপ ও সামাজিক চাপ
ঘৃণামূলক বক্তব্যের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, এবং আইনগত বৈষম্যবিরোধী নীতিমালা ব্যবহার করে পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
শেষ কথা
আমরা কী এমন একটি সমাজ চাই, যেখানে একজন মানুষ কেবল তার পরিচয়ের কারণে ঘৃণিত হবে? যেখানে একজন আলোচক জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য মানুষের সম্মান ছিঁড়ে ফেলতে পারেন?
আসিফ মাহতাবের বক্তব্য আমাদের একটি প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে: আমরা কি মানবিকতা ও সহমর্মিতার পক্ষে, নাকি ঘৃণা ও বিভেদের পক্ষে?
আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব—ঘৃণার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, ভালোবাসা ও মানবাধিকারের পক্ষে অবস্থান নেওয়া।