বাংলাদেশে LGBTQ (লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার ও কুইয়ার) ইস্যু দীর্ঘদিন ধরে এক গোপন ও ভীতির আবহে থেকে গেছে। ধর্মীয় রক্ষণশীলতা, সামাজিক ট্যাবু এবং আইনগত অস্পষ্টতার মধ্যে LGBTQ ব্যক্তিরা নিজেদের অস্তিত্বকে প্রকাশ করাও কঠিন মনে করে। এই নিস্তব্ধতা ভাঙার এক সাহসী উদ্যোগ ছিল ‘রূপবান’ ম্যাগাজিন, যেটি দেশের প্রথম এবং একমাত্র LGBTQ-ভিত্তিক প্রকাশনা হিসেবে ২০১৪ সালে আত্মপ্রকাশ করে। এই ম্যাগাজিনের প্রধান উদ্যোক্তাদের একজন ছিলেন জুলহাজ মান্নান, যিনি আমেরিকান দূতাবাসের প্রটোকল অফিসার এবং একাধারে LGBTQ অধিকারের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন।
রূপবান ম্যাগাজিন LGBTQ সম্প্রদায়ের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করত, যেখানে তাদের গল্প, সংগ্রাম এবং স্বপ্নগুলো প্রকাশ পেত। এটি শুধুই একটি ম্যাগাজিন ছিল না—বরং এটি ছিল একটি আন্দোলনের সূচনা। ‘রূপবান’-এর নামটি এসেছে বাংলার লোককাহিনির চরিত্র ‘রূপবান’ থেকে, যার মধ্য দিয়ে সৌন্দর্য, ভালোবাসা ও গ্রহণযোগ্যতার একটি সাংস্কৃতিক প্রতীক তৈরি করা হয়।
তবে এই সাহসী পদক্ষেপই হয়ে ওঠে একটি চরম সহিংস ঘটনার জন্মদাতা।
২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল, ঢাকার কলাবাগানের নিজ বাসায় জুলহাজ মান্নান এবং তার বন্ধু, নাট্যকর্মী তানয় মজুমদারকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে উগ্রপন্থী ইসলামি জঙ্গিরা। হত্যাকারীরা পরিকল্পিতভাবে তাদের টার্গেট করেছিল, কারণ তারা LGBTQ অধিকারের পক্ষে সক্রিয় ছিলেন এবং সমাজে এক ‘অবাঞ্ছিত’ আলোচনার সূত্রপাত করেছিলেন।
এই ঘটনা ছিল শুধু একটি ব্যক্তি বা একটি সংগঠনের বিরুদ্ধে নয়, বরং এটি ছিল পুরো LGBTQ সম্প্রদায়ের ওপর একটি বার্তা—তারা যেন চুপ থাকে, লুকিয়ে থাকে, এবং নিজেদের প্রকাশ না করে। হত্যাকাণ্ডের পর সরকার কিছু নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিলেও LGBTQ অধিকার বিষয়ে কোনো ইতিবাচক বার্তা বা আইনগত অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। বরং এরপর থেকে এই ইস্যুতে আলোচনা করাই যেন একপ্রকার নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে।
বাঁধার ধরণ ও প্রভাব:
এই ঘটনাটি বাংলাদেশে LGBTQ অধিকারের পথ রুদ্ধ করে দেয় নানা দিক থেকে:
- ভয়ের সংস্কৃতি: কর্মীরা তাদের কার্যক্রম গোপন করে ফেলেন। সংগঠনগুলো বন্ধ হয়ে যায়। অনেকে দেশ ছাড়েন।
- আইনগত নিরাপত্তার অভাব: বাংলাদেশের দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারায় সমকামিতাকে এখনও ‘অপ্রাকৃতিক অপরাধ’ হিসেবে গণ্য করা হয়। ফলে LGBTQ ব্যক্তিরা আইনগতভাবেও অনিরাপদ।
- সামাজিক নিষেধ: পরিবার, সমাজ ও মিডিয়া এই আলোচনাকে তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করে। LGBTQ-সম্পর্কিত সংবাদে ট্রোল, হুমকি ও বিদ্বেষমূলক ভাষার ছড়াছড়ি থাকে।
- নাগরিক সমাজের নীরবতা: অনেক মানবাধিকার সংগঠনও এই ইস্যুতে সরাসরি কথা বলতে দ্বিধান্বিত থাকে, যাতে তারা সরকারের রোষানলে না পড়ে।
জুলহাজ মান্নান হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের ইতিহাসে LGBTQ ইস্যুকে আলোচনার কেন্দ্রে এনে দিলেও, সেটি ইতিবাচক পরিবর্তনের পরিবর্তে নিঃশব্দতায় রূপ নেয়। ২০২১ সালে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য পাঁচজন জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, তবে মূল প্রশ্ন থেকে যায়—এই বিচার কি ভবিষ্যতের LGBTQ কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেরেছে?
বাংলাদেশে LGBTQ অধিকারের ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত। জুলহাজ মান্নান ও তানয় মজুমদারের আত্মত্যাগ হয়তো আজ নিঃশব্দ, কিন্তু ইতিহাস তাদের মনে রাখবে সাহসের প্রতীক হিসেবে। যখনই এই সমাজে বৈচিত্র্য ও গ্রহণযোগ্যতার আলো দেখা দেবে, তখন এই ঘটনার মূল্য আবার নতুন করে উপলব্ধি হবে।