বাংলাদেশ গত কয়েক দশকে উন্নয়ন ও সামাজিক অগ্রগতির নানা সূচকে দৃশ্যমান সাফল্য অর্জন করেছে। বিশেষ করে লিঙ্গ সমতার ক্ষেত্রে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নারীদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ এবং স্বাস্থ্যখাতে প্রবেশ আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। তবুও, সমাজে বিদ্যমান কিছু কাঠামোগত ও সাংস্কৃতিক বাধা এখনো লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য দূর করার পথে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
নারীর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে অগ্রগতি
বাংলাদেশে নারী শিক্ষায় বিস্ময়কর অগ্রগতি হয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মেয়েদের ভর্তি হারের দিক থেকে এখন ছেলেদের চেয়েও এগিয়ে। UNESCO-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষায় লিঙ্গ সমতা প্রায় অর্জিত হয়েছে। মেয়েদের জন্য উপবৃত্তি, বিনামূল্যে বই বিতরণ এবং বিদ্যালয়ে শৌচাগারের ব্যবস্থা এই অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করেছে।
স্বাস্থ্যখাতে, মাতৃমৃত্যু হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ২০০১ সালে প্রতি লাখে যেখানে ৩২২ জন নারী মাতৃত্বজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করতেন, ২০২০ সালে তা নেমে এসেছে ১৬৩-তে (সূত্র: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)। পরিবার পরিকল্পনা, প্রসূতি স্বাস্থ্যসেবা ও সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে এই উন্নতি সম্ভব হয়েছে।
নারীর কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ
নারীদের অর্থনৈতিক অংশগ্রহণের হারও ক্রমাগত বাড়ছে। পোশাকশিল্পে নারীর অংশগ্রহণ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। বর্তমানে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক এই খাতে কাজ করেন, যার মধ্যে ৮০ শতাংশই নারী। এছাড়া, ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি ও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে ভূমিকা রাখছে।
তবে এখানেও সমস্যার জায়গা রয়েছে। নারীদের বেশিরভাগই অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন, যেগুলোতে শ্রমিক অধিকারের নিশ্চয়তা কম। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি, মাতৃত্বকালীন সুবিধার অভাব এবং ন্যায্য মজুরি না পাওয়ার অভিযোগ এখনো অনেকাংশে বিদ্যমান।
রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন
সংবিধান অনুযায়ী, বাংলাদেশে নারীর রাজনৈতিক অধিকার সুরক্ষিত। জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনের মাধ্যমে নারীরা নিয়মিতভাবে প্রতিনিধিত্ব করছেন। বর্তমানে (২০২4 সালের তথ্যানুযায়ী) সংসদে নারী প্রতিনিধির সংখ্যা প্রায় ৫০ জনের বেশি। পাশাপাশি, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ বেড়েছে।
তবে এটি এখনো গঠনমূলক অংশগ্রহণ নয় বলে সমালোচনার মুখে পড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া নারীর নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থান গড়ে তোলা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
সামাজিক বাধা ও বৈষম্য
সমাজে নারীদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এখনো লিঙ্গ বৈষম্যের বড় কারণ। বাল্যবিয়ে, গৃহস্থালির অগণ্য দায়িত্ব, দাম্পত্য জীবনে সহিংসতা এবং দৃষ্টিভঙ্গিগত সংকীর্ণতা নারীর বিকাশকে ব্যাহত করে। UNICEF-এর তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে এখনও প্রায় ৫১ শতাংশ নারী ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয়ে যায়।
তাছাড়া, Decision-making বা সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা এখনও সীমিত। পরিবার, কর্মক্ষেত্র এবং সমাজে নারীদের অনেক সিদ্ধান্তই পুরুষদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
ভবিষ্যতের পথচলা
লিঙ্গ সমতা অর্জনে সরকারি নীতি, আইন ও আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের পাশাপাশি প্রয়োজন সামাজিক মনোভাবের পরিবর্তন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে লিঙ্গ সচেতনতামূলক পাঠক্রম অন্তর্ভুক্তি, গণমাধ্যমে ইতিবাচক নারী চিত্র উপস্থাপন এবং সামাজিক আন্দোলন—সবকিছু মিলে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতার সমাজ গঠনে সহায়ক হতে পারে।
নারীর উন্নয়ন মানে শুধু নারী নয়, পুরো জাতির অগ্রগতি। তাই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য দূর করে নারীদের পূর্ণ ও সমঅধিকারে সমাজে অন্তর্ভুক্ত করাই হবে টেকসই ভবিষ্যতের মূল চাবিকাঠি।