বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বহু দেশে সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্য একটি জাতির আত্মপরিচয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এসব উপাদান যুগের পর যুগ ধরে গড়ে উঠেছে সমাজের বিবর্তন, লোকজ বিশ্বাস, ধর্ম, দর্শন ও ইতিহাসের ছাঁচে। তবে দুঃখজনকভাবে, কিছু মৌলবাদী গোষ্ঠী এ সকল বৈচিত্র্যপূর্ণ ঐতিহ্যের ওপর বারবার আঘাত হানে। তারা দেশীয় সংস্কৃতিকে ‘অপবিত্র’, ‘বিধর্মীয়’ বা ‘ইমানবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে সামাজিক বিভাজন সৃষ্টি করে। এ ব্লগে আমরা মৌলবাদীদের এ আচরণের গাঠনিক সমালোচনা করব এবং বিশ্লেষণ করব কীভাবে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সমাজের সামগ্রিক সুস্থতা ও অগ্রগতিকে ব্যাহত করে।
মৌলবাদ একটি র্যাডিকাল চিন্তাধারা, যেখানে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী একটি নির্দিষ্ট মতবাদকে পরম সত্য ধরে নিয়ে অন্য সকল মতবাদ, সংস্কৃতি বা চিন্তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। এটি গড়ে ওঠে ভয়, অজ্ঞানতা ও একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষা থেকে। সংস্কৃতি যেখানে বহুমাত্রিক ও অভিযোজিত, সেখানে মৌলবাদ একরৈখিক এবং অনমনীয়। এই কারণে মৌলবাদ সংস্কৃতির স্বাভাবিক বিকাশকে দমিয়ে রাখে।
বহু সময় মৌলবাদীরা সংস্কৃতিকে আক্রমণের মাধ্যমে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চায়। লোকজ সঙ্গীত, উৎসব (যেমন পহেলা বৈশাখ), নাট্যচর্চা বা ঐতিহ্যবাহী পোশাককে ধর্মবিরোধী বলে আখ্যা দিয়ে তারা জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। এর মাধ্যমে একটি ‘আমরা বনাম তারা’ ধাঁচের মেরুকরণ গড়ে তোলে, যা সামাজিক সহাবস্থানকে ধ্বংস করে এবং মৌলবাদীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা সহজ করে।
যখন কেউ বলে যে ঢাকাই মসলিন, বাউল সঙ্গীত, কিংবা কীর্তনের মত ঐতিহ্য শুধুই ‘গণহারে শিরক’ – তখন তারা ইতিহাস, নৃতত্ত্ব ও সমাজবিজ্ঞানের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে। এ ধরনের মানসিকতা শুধুমাত্র ধর্মীয় কুসংস্কারই নয়, বরং এটি এক প্রকার সাংস্কৃতিক নির্যাতনও বটে। এর ফলে নতুন প্রজন্ম অতীতের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের ইতিহাস প্রমাণ করে যে এখানে ধর্ম ও সংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে সহাবস্থান করে এসেছে। পল্লী জীবনের উৎসব, বিয়ে, কৃষিনির্ভর মেলা – এসব কিছুর মধ্যে ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে সামাজিক সম্প্রীতি ও মানবিক বন্ধন। মৌলবাদীরা যখন এসব ঐতিহ্যকে আঘাত করে, তখন তারা বাস্তব সমাজবিজ্ঞান নয়, বরং কল্পিত এক ‘শুদ্ধ সমাজ’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যা আসলে কাল্পনিক ও অমানবিক।
শুদ্ধ সংস্কৃতি’র নামে যা মৌলবাদ প্রচার করে, তা একটি চরম স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা। এটি বৈচিত্র্যকে শত্রু মনে করে, ভিন্নমতকে নিধনের মাধ্যমে একক রূপ চাপিয়ে দিতে চায়। এই প্রবণতা দীর্ঘমেয়াদে শুধু সাংস্কৃতিক দারিদ্র্যই নয়, বরং সৃজনশীলতার বিলুপ্তি ঘটায়। একজন নজরুল, হাসন রাজা, কিংবা রবীন্দ্রনাথের উদ্ভব সম্ভব হতো না যদি সমাজ একরৈখিক চাপে পরিচালিত হতো।
দেশীয় সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্য কোনো ধর্মের বিপরীতে নয়, বরং মানুষের বহুমাত্রিক জীবনের অংশ। মৌলবাদীদের বিরূপ আচরণ শুধু সংবেদনশীল নয়, তা সমাজবিরোধীও। আজকের সময়ে প্রয়োজন, এসব বিভেদকারী দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা, এবং এক উদার, জ্ঞানে-ভিত্তিক সংস্কৃতিচর্চা প্রতিষ্ঠা করা। কারণ, সংস্কৃতিকে বাঁচানো মানে একটি জাতিকে তার আত্মপরিচয় ফিরিয়ে দেওয়া।