July 15, 2025

Banner Image

বিচিন্তা

মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা, ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জাতীয় নিরাপত্তা: একটি বিশ্লেষণ

বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা বহুদিন ধরেই একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাদ্রাসাভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতির একাংশ নিয়ে জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে—বিশেষ করে যখন দেখা যায় যে কিছু মাদ্রাসায় ধর্মীয় উগ্রবাদ, অসহিষ্ণুতা এবং আধুনিক জ্ঞানের প্রতি বিরূপতা ছড়িয়ে পড়ছে। এসব সমস্যা যখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়, তখন তা শুধু একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ভেতর সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং জাতীয় পর্যায়ে একটি মৌলিক সংকটের রূপ নেয়।

ধর্মীয় উগ্রবাদ কীভাবে জন্ম নেয় মাদ্রাসায়?

বাংলাদেশে মাদ্রাসা broadly দুই ধরনের: আলিয়া মাদ্রাসা এবং কওমি মাদ্রাসা। আলিয়া মাদ্রাসায় সরকার নির্ধারিত পাঠ্যক্রম অনুযায়ী ধর্মীয় এবং সাধারণ শিক্ষা দেয়া হয়, যেখানে কওমি মাদ্রাসা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারি পর্যবেক্ষণের বাইরে থেকে সম্পূর্ণ নিজস্ব পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়।

কিছু কওমি মাদ্রাসায় এমন পাঠ্যক্রম ও পরিবেশ গড়ে ওঠে যেখানে আধুনিক বিজ্ঞান, দর্শন, সমাজতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়গুলোকে অবিশ্বাস করা শেখানো হয়, এবং ভিন্নমত, ভিন্ন ধর্ম বা ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি ঘৃণা জন্মায়। ছাত্রদের শিশু বয়স থেকে শেখানো হয় যে শুধুমাত্র তাদের ধর্মীয় ব্যাখ্যা সঠিক, এবং যারা এটির বাইরে, তারা শত্রু। এই মনোভাব ধীরে ধীরে উগ্র মতাদর্শে রূপ নেয়।

জাতীয় পর্যায়ে এর প্রভাব

১. সামাজিক বিভাজন
উগ্রবাদী চিন্তা তরুণদের একঘরে করে ফেলে। তারা সমাজের অন্য অংশের মানুষকে ‘কাফের’ বা ‘ভ্রান্ত’ বলে মনে করতে শুরু করে। ফলে সমাজে সহাবস্থানের জায়গাটা সংকুচিত হয়ে পড়ে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, নারী অধিকার, বা ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাধারার প্রতি ঘৃণা বাড়তে থাকে।

২. সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি
ধর্মীয় সংকীর্ণতা থেকে যখন ‘জিহাদি’ মতাদর্শে বিশ্বাস জন্মায়, তখন সেটা অস্ত্র তুলে নেয়ার মতো পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়। বাংলাদেশে ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময়ে মাদ্রাসা-সম্পর্কিত চরমপন্থী গোষ্ঠীর নাম উঠে এসেছে যারা হামলা, হত্যা বা রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রে জড়িত।

৩. মানবসম্পদ ও শিক্ষার মান হ্রাস
যেসব শিক্ষার্থী কেবলমাত্র সংকীর্ণ ধর্মীয় ব্যাখ্যা নিয়েই বড় হয়, তাদের উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞানমনস্কতা বা কর্মজীবনে সফলতা পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। ফলে একটা বড় তরুণ জনগোষ্ঠী ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হয় না।

৪. রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর প্রতি হুমকি
বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলেও এই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা একটি সমান্তরাল ‘আইডিওলজিকাল স্টেট’ গড়ে তোলে। যেখানে রাষ্ট্রের আইন নয়, বরং ফতোয়া ও ধর্মীয় ব্যাখ্যা বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।

সমাধান কী?

  1. শিক্ষা সংস্কার: মাদ্রাসাগুলোকে জাতীয় পাঠ্যক্রমে আনা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা উচিত।
  2. উপযুক্ত মনিটরিং: ধর্মের নামে ঘৃণা, সহিংসতা বা উগ্রতা ছড়ানো হচ্ছে কিনা তা নজরদারিতে রাখা জরুরি।
  3. সচেতনতা বৃদ্ধি: ধর্মের মানবিক দিক, সহনশীলতা ও সহাবস্থানের বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে শেখানো উচিত।
  4. ইমাম ও আলেমদের প্রশিক্ষণ: আধুনিক ও মানবিক ব্যাখ্যায় ধর্ম প্রচারে আলেমদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ইতিবাচক রূপান্তর সম্ভব।

ধর্মীয় শিক্ষা কখনোই উগ্রতা বা সংকীর্ণতার বাহক হওয়া উচিত নয়। ইসলাম যেমন শান্তি ও সহনশীলতার ধর্ম, তেমনি একটি উন্নত রাষ্ট্রের মূল ভিত্তিও হলো মতের পার্থক্য মেনে চলা ও মানবিক সহাবস্থান। মাদ্রাসা শিক্ষাকে জাতীয় উন্নয়নের সহযাত্রী করতে হলে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও উগ্রবাদকে প্রতিহত করতে হবে, যুক্তিনির্ভর ও আধুনিক শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে হবে।

Share: Facebook Twitter Linkedin
Leave a Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *